কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক গত ২৪ জুলাই সংসদে জানিয়েছে যে ভারতের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ মার্চ ২০১৮-তে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা। শুধু ২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই বিপুল পরিমাণ ঋণ ব্যাঙ্কগুলিকে ফেরত দেওয়া হয়নি, হয় ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা ঋণগ্রহীরা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায়।
এই ১০ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণের সিংহভাগ নিয়েছে বড়ো ঋণগ্রহীরা, যারা ৫ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। মোট অনাদায়ী ঋণের মধ্যে ৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা বড়ো ঋণগ্রহীদের খাতায় রয়েছে। প্রথম ১০০ জন ঋণগ্রহীর খাতায় রয়েছে ২.৬ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ। এরা আমাদের দেশের প্রথমসারির ধনী পুঁজিপতি, যারা বড়ো বড়ো কোম্পানির মালিক।
আগের ইউপিএ সরকারের আমলে ব্যাঙ্কঋণ দেওয়া নিয়ে চূড়ান্ত অব্যবস্থা এবং দুর্নীতি হয়েছে। মোদী সরকারও আগের কংগ্রেস সরকারের উপরে দায় চাপিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে। ঋণগ্রহী কর্পোরেটদের থেকে অনাদায়ী ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। সরকারকে কাঁচকলা দেখিয়ে বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সি’র মতন ব্যাঙ্ক-জালিয়াতরা কোটি কোটি টাকা লুঠ করে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
অনাদায়ী ঋণ উদ্ধার করার জন্য ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে মোদী সরকার নতুন দেউলিয়া বিধি (Insolvency and Bankraptcy Code) লাগু করে। এই আইনের আওতায় সবথেকে বড় ঋণখেলাপের ১২টি ঘটনা নিয়ে গত দেড় বছর ধরে এনসিএলটি-তে নিষ্পত্তির মামলা চলেছে। এই মামলাগুলিতে আটকে আছে ৩.২৫ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২টি মামলা, ইলেক্ট্রোস্টিল আর ভূষণ স্টিল।
কেন্দ্রীয় কোম্পানি বিষয়ক দফতরের তথ্য অনুযায়ী এদের থেকে ব্যাঙ্কগুলির পাওনা ছিল প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা, নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৪১ হাজার কোটি টাকায় – অর্থাৎ ব্যাঙ্কগুলির প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার লোকসান। এদিকে বেদান্ত গ্রুপ জলের দরে কিনে নিচ্ছে ইলেক্ট্রোস্টিল, আর টাটারা কিনে নিচ্ছে ভূষণ স্টিলকে। ভেবে দেখার বিষয়, যদি ৭০ হাজার কোটির অনাদায়ী ঋণে ৩০ হাজার কোটির লোকসান হয়, তাহলে ১০ লক্ষ কোটির অনাদায়ী ঋণে লোকসানটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
Corporate loan defaulters২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে, দেশের ২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭০০০০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি কিন্তু তাদের নিজস্ব পরিষেবা প্রদানের মধ্য দিয়ে মুনাফা লাভ করছে (operating profit positive)। তবুও তাদের লোকসান হচ্ছে। কারণ, অনাদায়ী ঋণগুলিকে কর্পোরেটদের থেকে আদায় না করে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে সেই ঋণ মকুব করে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থর্বষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি মোট ১.২ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মকুব করেছে। বিগত চার বছরে (২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক মোট তিন লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণ মকুব করেছে।
একদিকে, ঋণখেলাপি, জালিয়াত কর্পোরেট-রা বিলাসিতা করছে, অন্যদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে শুষে নেওয়া হচ্ছে। ‘Prompt Corrective Action’-এর নিয়মের অজুহাতে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের দৈনন্দিন কার্যক্রমে বাধা প্রদান করছে, যার ফলে তারা সঠিকভাবে গ্রাহকদের ঋণের জোগান দিতে পারছে না। দেশের মোট ঋণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অনুপাত যেখানে কয়েক বছর আগে ৭০%-র উপরে ছিল, বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৬৫%তে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ঋণ এবং আমানত বৃদ্ধির হার কমছে, বেসরকারি ব্যাঙ্কের বৃদ্ধির হার বাড়ছে। অর্থাৎ, ঘুরপথে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ হয়ে চলেছে।
ব্যাঙ্কের সাধারণ গ্রাহকেরা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমানতের উপরে সুদের হার কমেছে, এটিএম পরিষেবার জন্য অতিরিক্ত মাশুল দিতে হচ্ছে, ন্যূনতম জমা রাশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তা না রাখতে পারলে অতিরিক্ত চার্জ আমানতগুলি থেকে কেটে নেওয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র চাষি, ক্ষুদ্র শিল্প এবং অন্যান্য ছোট ঋণগ্রহীদের ঋণ দেওয়া কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, বড়ো গ্রাহকেরা লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে, তা ফেরত না দিয়ে, ব্যাঙ্কগুলিকে পথে বসাচ্ছে, আর ছোট গ্রাহকদের তার খেসারত দিতে হচ্ছে। দেশের অসংখ্য সাধারণ ব্যাঙ্ক গ্রাহক, যারা জীবনের জমানো পুঁজি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে জমা রেখেছেন, তাদের স্বার্থ আজ বিপন্ন।