এই বছর এপিটাফ লেখার বছর। অবিচুয়ারি লিখে লিখে মানুষ ক্লান্ত। আত্মীয় পরিজন থেকে বিশেষ কেউ। কেবল চলে যাওয়া। একা এবং একা। আজ সকালে উঠেও দুঃসংবাদ। চলে গেলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। অসুস্থতার কারণ ভিন্ন কিন্তু ট্র্যাজিক চিত্রনাট্যের সময়কাল এক। ফ্রেম এবং সিকোয়েন্স একটাই, মৃত্যু।

বাবার প্রিয় পরিচালক তিনি। তাই আমার প্রথম হলে গিয়ে যেকটি ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তার মধ্যে বাঘ বাহাদুর একটি। গভীর ইম্প্যাক্ট পড়েছিল মনে। ভার হয়েছিল মন, ওরকম পরিণতি! উফ! নতুন নতুন বিনোদনের উপাদান এসে পুরনোকে সমূলে উপড়ে নিচ্ছে! বাঘের মতো সেজে বাঘের নাচ, বাঘের সমস্ত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা মানুষের সঙ্গে জ্যান্ত বাঘের লড়াই মেনে নিতে পারিনি আমি। খুব রাগ হয়েছিল বাবার ওপর। ভালো চোখ তৈরি করার তাগিদ নিতে গিয়ে মন খারাপের দায় পড়ল পরিচালক ও বাবার ওপর।

তারপর যত বড়ো হয়েছি বুঁদ হয়েছি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি দেখে। বেদনা, বিস্ময়, বোধ, বাস্তবতার অন্য রূপ সমৃদ্ধ করেছে কেবল। মন, মস্তিষ্ক আলোড়িত হয়েছে। কবিতা পড়লে যেমন হয়। কেমন ধীরে ধীরে সেঁধিয়ে যায় অন্দরে, তারপর বিরাট এক গহ্বরের মধ্যে তারা নড়ে চড়ে, আর উস্কে দেয় কত চিত্রকল্প, প্রহসন, আলো, অন্ধকার, প্রেম, মায়া, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ…।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নিজের শর্তে ছবি নির্মাণ করেছেন আজীবন। তাঁর ভাবনা, নান্দনিকবোধ, চিত্রভাষা যা তিনি বলতে চেয়েছেন তাই গুরুত্ব পেয়েছে। শেষ ছবি উড়োজাহাজ দেখতে গিয়েছিলাম নন্দনে এই তো এক-দেড় বছর আগেই, দেখলাম তিনি বদলাননি কোনও শর্তেই। বেঁচেছেন সেই নিমগ্ন বেহালা বাদকের মতোই, যিনি বিশুদ্ধ সুরে, লয়ে, সমগ্র সঙ্গীতের পরিপূর্ণতায় নিমজ্জিত। সমালোচক, গোষ্ঠীপতি, বাজার কি বলল তাঁর কিস্যু এসে যায় না। তাঁর একমাত্র দায়বদ্ধতা শিল্পের কাছে। আর তাই দর্শকরা বুঝতে পারতেন কোনও ফাঁকি নেই, কোনও আপোষ করার প্রবণতা নেই আর নিটোল গল্প বলে কেবল বিনোদনের দায় তিনি মেটাতে চাননি কোনওদিন। তাঁর ধরণ তাঁরই। আর কেউ পারেননি ওমন করে বাস্তব-জাদুবাস্তব, কল্পনা-চিত্রকল্প, কবিতা-বায়োস্কোপ মিশিয়ে দিতে। উচ্চমানের কবি বলেই পারতেন বোধহয়। চরাচরের ওই সমুদ্র দৃশ্য, কালপুরুষে বাঁশিওয়ালার ফিরে ফিরে আসা, উত্তরায় বেঁটে মানুষদের স্বপ্ন আকাঙ্খা, জানলায় নায়কের স্কুলের জানলা নিয়ে ওই রোমান্টিকতা, উড়োজাহাজে জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যক্ত উড়োজাহাজ নিয়ে নায়কের উন্মাদনা আমাদের মগ্ন করেছে। সিনেমায় জাদুবাস্তবতা সম্ভব। তাঁর মতো করে একথা কেউ বলেননি তাঁর আগে। প্রথিতযশা এই দেশের চিত্রপরিচালকরাও নন। তিনিই এই আঙ্গিকের স্রষ্টা এবং মায়েস্ত্রো। সিগনেচার দুই একটি দৃশ্য থাকত তাঁর, পুরুলিয়ার ধূ ধূ প্রেক্ষাপট, কিছু আশ্চর্য মানুষ, তাঁদের অদ্ভুত স্বপ্ন, কিছু চেতন, কিছুটা অবচেতন, সব মিলিয়ে পরিচালক আমাদের ভেতরের মনটার ওপর প্রভাব বিস্তার করতেন জাদুকরের মতোই, কবিদের মতোই। সেই মোহ কাটে এমন সাধ্য কারও নেই।

যদিও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রথম দিককার ছবিগুলোর প্রেক্ষাপট ছিল রাজনীতি, সমাজ, নকশাল আন্দোলন। প্রত্যক্ষ করেছেন রাজনীতি, রাজনৈতিক জীবন তাই নকশালবাড়ি আন্দোলন, ভাঙন, দ্বন্দ্ব স্বপ্নভঙ্গ সব উঠে এসেছে তাঁর প্রথমদিককার ছবিগুলিতে। এবং পরের আরও কিছু ছবিতে। আর এসেছে নিজের দেখা জীবন, ছোটোবেলা, গ্রামের জীবন, স্বপ্ন, জীবনযাত্রা। তিনি বলতেন, “আসলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই একটা জার্নি। সেটা কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। একজন সৃষ্টিশীল মানুষের বিশেষত্ব হল- এই জার্নিটা তুলে ধরা।” কিন্তু তাঁর দেখা… শিল্পীর দেখা কিংবা কবির দেখা, তাই ভিন্ন। ছবির আঙ্গিক, নির্মাণ পৃথক বাকিদের থেকে। শুটিং-এর মাঝেই গাছের ডাল বেয়ে অনেক উইপোকার একসঙ্গে নেমে আসা দেখে তিনি চমকিত হন এবং ফ্রেমবন্দি করে ফেলেন, চিত্রনাট্যে হঠাৎ করেই সে দৃশ্য জুড়ে যায়। আবার ছোটোবেলায় কিংবা বড়ো হয়ে শোনা সঙ্গীত, পড়া কবিতা মাথার মধ্যে তৈরি করে ফেলত নানা ইমেজারি পরে সেগুলোই ছবির মধ্যে এসেছে ঘুরে ফিরে। কবিতা এবং সিনেমার কোনও বিরোধ ছিল না তো তাঁর কাছে।

কত পুরস্কার, সম্মান পেয়েছেন দেশে বিদেশে। এথেন্স এবং স্পেনের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পেয়েছেন ‘লাইফ- টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কার। এ দেশের জাতীয় পুরস্কার স্বর্ণকমল অর্জন করেছেন একাধিকবার- বাঘ বাহাদুর, চরাচর, লাল দরজা, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, কালপুরুষ জাতীয় পুরস্কার পায়। ‘তাহাদের কথা’ ছবির জন্য মিঠুন চক্রবর্তী জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন।

ছবির সঙ্গে রয়ে গেল তাঁর আর এক যাপনের সাক্ষর- ‘রোবটের গান’, ‘গভীর আড়ালে’, ‘ছাতা কাহিনী’, ‘কফিন কিংবা সুটকেশ’, ‘হিমযোগ’, ‘ভূতেরা কোথায় থাকে’ – এর মতো কবিতার বই। এই পরিচালকের মামা ছিলেন প্রখ্যাত কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। মামার বাড়িতেই দেখতে পেয়েছিলেন বিখ্যাত সব কবিদের। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, তারাপদ রায় প্রমুখ স্বনামধন্যরা হাজরা রোডের মামার বাড়িতে আসতেন। সমরেন্দ্র ছিলেন ফিল্ম সোসাইটির সদস্য। কবিতা ও ফিল্ম, এসবের মোহ, আকর্ষণ মামার কাছ থেকে সঞ্চারিত হয়েছিল বুদ্ধদেবের মধ্যে। শুরু হয়েছিল যাত্রা। সেই যাত্রা থামেনি। না মৃত্যুও থামাতে পারবে না সেই জার্নি। কারণ জানি, আমরা আবিষ্কার করব তাঁকে যতবার দেখব তাঁর ছবি, যতবার পড়ব তাঁর কবিতা।