পয়লা এপ্রিল, ২০১৬ তারিখে ‘বিতর্ক’তেই বিবেকানন্দ উড়ালপুল দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে লেখা শেষ করেছিলাম একটা দুশ্চিন্তা নিয়ে –“…তাই হয়ত কিছুদিন পরে আবার নতুন করে লিখতে হবে- ‘আরও একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা শহর কলকাতায়’…”। সেটাই সত্যি হয়েছে এবং আরও একবার প্রাণ গেছে সাধারণ মানুষের এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী ভোগান্তিও ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই।
ভেঙে পড়ল মাঝেরহাট সেতু। যথারীতি রাজনৈতিক মহলের দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের চাপানউতরে সরগরম সংবাদমাধ্যম। সেতু বিশেষজ্ঞদের মতামতকে উপেক্ষা করে প্রতিদিন খবরের কাগজে বা টিভি চ্যানেলে নানা মুনির নানা মত শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
কেন ঘটল এই দুর্ঘটনা? এতদিনে টেলিভিশন ও সংবাদপত্র মারফত সবাই আমরা তার নানা কারণ সম্বন্ধে ইতিমধ্যেই অবহিত। আমি ব্রিজ-বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু নির্মাণবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার দরুন ও সাধারণ জ্ঞান যা আছে তাতে এটা বোঝার জন্য অবশ্যই কোনও নোবেল বরাদ্দ নেই যে যেকোনও নির্মাণশিল্পেরই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মতোই নানা বার্ধক্যজনিত ক্লান্তির জন্ম হয়। তাই একটা বয়সের পর মানুষকেও যেমন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রুটিন শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ওষুধপত্রের মধ্য দিয়ে সচল থাকতে হয়, ঠিক তেমনই একটা পুরোনো ব্রিজের ক্ষেত্রেও বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যপরীক্ষার দরকার হয়। আর ওষুধ খাওয়ার মতো প্রয়োজনে তার retrofitting-এরও দরকার পড়ে। কিন্তু সেতুর ক্ষেত্রে এই স্বাস্থ্যপরীক্ষা একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে প্রতিনিয়ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে করে যেতে হয়। এবং প্রয়োজনে দ্রুততার সঙ্গে তার আরোগ্য নিশ্চিত করতে হয়। না হলে শহরের অন্যান্য সেতু এবং উড়ালপুলগুলো নীল সাদা রঙে ও নিয়ন আলোয় আপাত মোহময়ী হয়ে আকর্ষণ করলেও তার শরীরে লুকিয়ে থাকবে মরণফাঁদ। রাজ্যের মুখ পুড়বে বারবার।
মেলা-মোচ্ছব, নিত্যনতুন পার্ক, রাস্তায় রাস্তায় ত্রিফলা আলোর ক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি শুনতে পাওয়া যায় না। অথচ ওগুলো একটু কম করে মানুষের রোজকার জীবনের একটু ভালো থাকার নিশ্চয়তা যদি দেওয়া যেত! আসলে ‘কস্মেটিক’ সৌন্দর্যায়ন থেকে বিচ্ছুরিত ‘উন্নয়ন’-এর আলো দিয়ে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সেতু মেরামতির ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি বাজেট থেকে তো মানুষকে চটজলদি ভুলিয়ে রাখা যাবে না…
মহামান্য পুর্তমন্ত্রী বা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কথায় উঠে এসেছে যে মেট্রোরেলের কাজের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মাঝেরহাট সেতুটি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এখনও এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়নি। কারণটা একটু সহজ করে বলার চেষ্টা করছি। মেট্রোরেলের কাজে সবচেয়ে বেশি কম্পন অনুভূত হয় ‘Piling’-এর সময় যা তার পার্শ্ববর্তী নির্মাণের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আর সেই প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ার সম্ভাবনা সেতুর সেই অংশের উপর যা মাটিতে প্রোথিত অর্থাৎ পায়ারের (Pier) উপর কারণ এই কম্পন মাটির মধ্যে দিয়েই বিস্তার লাভ করে। কিন্তু প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা গেছে সেতুর পায়ার ক্ষতিগ্রস্ত নয়। দ্বিতীয়ত সেতুর যে অংশ ভেঙ্গে পড়েছে তার সবচেয়ে নিকটবর্তী অংশে মেট্রোরেলের Piling শেষ হয়ে গেছে আজ থেকে এক বছর আগে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই সেই Piling এর সময়ে সেতুর এই অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাহলে প্রশ্ন আসে নির্মাণটির স্বাস্থ্যপরীক্ষায় তা সঙ্গে সঙ্গে কেন ধরা পড়ল না?
এবার আসি পরের প্রসঙ্গে। নিয়মিত না হলেও শুনলাম বছর দুয়েক আগে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ্ররা unfit ঘোষণা করেছিল এই সেতুটিকে এবং দ্রুত retrofitting-এর নিদান দেন। সেইমতো টেন্ডার ডাকা হয়। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে বারবার টেন্ডার ডেকেও সেই টেন্ডার ফাইনাল করে উঠতে পারেনি প্রশাসন। ফলস্বরূপ সেতুর ভেঙে পড়া এবং কিছু নির্দোষ জ্যান্ত মানুষের হঠাৎই লাশ হয়ে যাওয়া। প্রশাসনের গড়িমসি কি দায়ী নয় এক্ষেত্রে? কেন হল না টেন্ডার ফাইনাল? বাজেট কম এবং খুব কম সময়সীমা। অন্যতম ব্যস্ত ব্রিজের মেরামতির কাজে (যেখানে কাজ করতে হবে শুধুমাত্র রাতে, যখন যানবাহন কম থাকবে) পর্যাপ্ত সময়সীমা কি ধার্য করেছিল প্রশাসন। পর্যাপ্ত বাজেট না থাকাও একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার যে এই precast pre-stressed bridge এর retrofitting এর খরচা সাধারণ মেরামতির থেকে অনেকটাই বেশি। মেলা-মোচ্ছব, নিত্যনতুন পার্ক, রাস্তায় রাস্তায় ত্রিফলা আলোর ক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি শুনতে পাওয়া যায় না। অথচ ওগুলো একটু কম করে মানুষের রোজকার জীবনের একটু ভালো থাকার নিশ্চয়তা যদি দেওয়া যেত! আসলে ‘কস্মেটিক’ সৌন্দর্যায়ন থেকে বিচ্ছুরিত ‘উন্নয়ন’-এর আলো দিয়ে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সেতু মেরামতির ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি বাজেট থেকে তো মানুষকে চটজলদি ভুলিয়ে রাখা যাবে না, বরং এই বাড়তি অর্থ বরাদ্দ হবে নানা ক্লাবে, যাদের নিরলস পরিশ্রম সরকারের ভোট বৈতরণী পার হওয়ার মূল মন্ত্র। যদিও সেইসব ক্লাবের কোনও সদস্য এশিয়াড থেকে কোনও মেডেল এনেছে বলে শুনিনি। কিন্তু ব্রিজ মেরামতির টাকা বরাদ্দ না হলেও বিভিন্ন পুজোকমিটিকে অর্থবরাদ্দ করতে প্রশাসনকে দুবার ভাবতে হয় না।
আরও পড়ুন: একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও কিছু কথা
সমাজের গভীরতম অসুখ হল এই সময়ে মানুষ বাহ্যিক আড়ম্বর দেখে চমকিত হয়। ভিতরের অসুখ চাপা পড়ে যায় মেকি ঔজ্জ্বল্যে। এই সেতুও ভিতরে ভিতরে খয়ে যাচ্ছিল, অনেকদিন ধরেই বড় বড় ফাটল দেখা যাচ্ছিল ওর শরীরে। সেই ফাটল দিয়ে বৃষ্টির জল ঢুকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিয়েছিল মূল কাঠামো্কে। সারা গায়ে গজিয়ে উঠেছিল বড় বড় গাছ। অথচ প্রশাসনের ঘুম ভাঙেনি। ব্রিজের নীচের অংশের (Under deck) অবস্থাও তথৈবচ। জায়গায় জায়গায় কংক্রিটের চাঙড় খসে পড়ে মূল কাঠামোর reinforcement steel দৃষ্টিগোচরে এসেছে। জল হাওয়ার সংস্পর্শে তাতে মরচে পড়েছে কালের নিয়মে এবং মূল কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দিনে দিনে। রঙের প্রলেপ দিয়ে যে ক্ষতিকে ঢাকা গেল না কিছুতেই।
এর সঙ্গে ব্রিজের উপরিভাগে অপরিকল্পিত মেরামতির দরুন পুরোনো পিচের উপর নতুন পিচের আস্তরণ পড়ে ব্রিজের উপর Dead load উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। ট্রাফিকের চাপ বেড়েছে রোজ কিন্তু এই অতিরিক্ত ভার বহনের জন্য পরিকাঠামোকে শক্তিশালী অর্থাৎ structural strengthening করার প্রয়োজন ছিল কিনা সে পর্যালোচনা আদৌ হয় না আমাদের রাজ্যে। যদি তা হত, তাহলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।
ভবিষ্যতেও তা হবে এমন আশা রাখি না, কারণ যদি তা হত বিবেকানন্দ উড়ালপুলের দুর্ঘটনার পর আমরা শিক্ষা নিতাম। আসল দোষীদের শাস্তি হত। যে কোনও মেরামতির কাজেরই সঠিক রূপরেখা তৈরি হত, কিন্তু তা কিছুই হয়নি। আমরা কিছুদিন এই নিয়ে তুমুল আলোচনা করব। তারপর কালের নিয়মেই ভুলে যাব সবকিছু। ভুলে থাকব ততদিন যতদিন না আরও একটা দুর্ঘটনা ঘটে শহর কলকাতার বুকে।
Comments are closed.