নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নামটা উচ্চারণ করলেই অনেক অনুভূতি হৃদয়ে একসঙ্গে খেলা করে। গর্ব, বেদনা, হতাশা, ভালোবাসা, অনুতাপ সবকিছু মিলেমিশে আমাদের মনকে আছন্ন করে রাখে (এখনকার কোনও নেতাকে যখন ‘নেতাজি’ নামে সম্বোধন করা হয় ততটাই বিরক্তি আর রাগ হয়)। এই মহান দেশনায়কের এমন কুয়াশা-ঘেরা পরিণতি মেনে নেওয়া বাঙালি তথা ভারতীয়দের বেশিরভাগের কাছেই বেশ অস্বস্তিকর। নেতাজির মৃত্যু রহস্য সমাধানের উদ্দেশ্যে যখনই নতুন কোনও কমিশন তৈরি হয়েছে কিংবা নতুন না-জানা তথ্য পাওয়া গেছে তখনই আমরা ভেবেছি- এই বুঝি জানা গেল ঠিক কী হয়েছিল বিমান দুর্ঘটনার পরে!
হাজারও রকমের তথ্য, বিশ্লেষণ তাঁর অন্তর্ধানের রহস্যকে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে অতীতে এবং সাম্প্রতিককালে, রহস্য আবারও নতুন করে জট পাকিয়েছে। ইতিহাসে যা আছে, উত্তর আধুনিক ইতিহাস তার বাইরের অনেক কিছুকেই এখন ইতিহাসের পরিসরে নিয়ে এসেছে, তাই গবেষণা যেমন হচ্ছে তেমনই রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে, প্রতিদিন। তাই টেলিভিশনে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনা, তারপর হয়ে চলা নানা ঘটনার ওপর নতুন করে আলোকপাত করে বিশেষ কোনও সিরিজ তৈরি হয় এবং তা দর্শককে, বিশেষ করে বাঙালি দর্শককে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। বই, তথ্যচিত্র, গবেষণাপত্র, পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, আবার কখনও ওয়েব সিরিজ- নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু পর্দায় বারবার ফিরে এসেছেন।
কারণ, পরিচালক-প্রযোজকরা জানেন যে রহস্য যেখানে, বিনোদন সেখানেই। আর সাধারণ দর্শকের উৎসাহও যথেষ্ট পরিমাণে সেদিকেই, পরিণামে প্রযোজকের লক্ষ্মীলাভ। তাই নেতাজিকে নিয়ে কৌতূহল ভীষণভাবেই বিদ্যমান। আবার এমন বহু মানুষ আছেন যাঁরা হুজুগের বশবর্তী না হয়ে, কোনওরকম রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই বিষয়টিকে না দেখে সত্যিই অন্বেষণ করতে চান- কী হয়েছিল নেতাজির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে? যাঁরা মনে করেন তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি তাঁদের এই খোঁজ চলবেই। নিজেদের মতো করে খোঁজ, পড়াশোনা আর গবেষণার মাধ্যমে শেষটা জানার অদম্য অনুসন্ধিৎসা বজায় থাকবেই। টেলিভিশনের একটি চ্যানেলের তৈরি করা তথ্যচিত্রে সাম্প্রতিককালে এমনও দাবি করা হয়েছে যে যাঁরাই নেতাজির খোঁজ পেয়েছেন তা ১৯৪৫ সালের পরে, কিংবা কোনও নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন- নেতাজির আকস্মিক মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়! হাজারও প্রশ্নচিহ্ন, হাজারও তথ্য, হাজারও রহস্য কিন্তু উত্তর কিছু জানা আর বেশিরভাগটাই অজানা।
কী নতুন তথ্য উঠে এসেছে একতা কাপুরের ‘বোস: ডেড/অ্যালাইভ।’ শীর্ষক ওয়েব সিরিজে? জানার ইচ্ছে ছিল তাই গ্রাহক হলাম অল্ট(ALT BALAJI) বালাজির। আর এও অস্বীকার করার উপায় নেই যে মুখ্য ভূমিকায় রাজকুমার রাওকে নেতাজির বেশে কেমন মানিয়েছে তা জানার প্রবল ঔতসুক্য ছিল। এই সিরিজে গল্প তাঁর কলেজ জীবন, আইসিএস ছেড়ে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ যোগদান, বিদেশে আত্মগোপন, প্রেম, বিয়ে, অন্তর্ধান, বিমান দুর্ঘটনা এবং সুভাষ চন্দ্র বসু বেঁচে আছেন কি না সে রহস্যের জট খোলার চেষ্টা এই নিয়েই গল্পের বিস্তার। শুরুতে সুভাষকে সুপারহিরো দেখানোর এক চেষ্টা ছিল প্রচ্ছন্নভাবে কিন্তু তার দরকার ছিল না। সুভাষের কর্মকান্ড সবসময় তাঁকে নায়কের আসনেই বসিয়ে রাখবে, সেখানে আরোপিত কোনওকিছুই বাড়তি মনে হয়। সঙ্গীতের ব্যবহারেও এই ছাপ থেকে যায়। নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করার জন্যই ওরকম উচ্চকিত গান কানকে পীড়ন করে, বরং রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নেতাজীর প্রিয় গানগুলোই খাপ খেত এক্ষেত্রে। নেতাজিকে নিয়ে ব্রিটিশ অফিসার স্ট্যানলির টানাপোড়েন এবং ধরতে না পারার ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি পরিবেশনের গুণে অভিনবত্ব হারায়।
নেতাজির সঙ্গে চেহারার তেমন মিল না থাকলেও রাজকুমারের অভিনয়গুণে সে বিষয় কখনওই মুখ্য হয়ে উঠবে না। দৃপ্ত ভঙ্গি, ঋজু ব্যক্তিত্ব, রসিকতা করার ধরণ হয়ত নেতাজির এমনই ছিল, এমনই মনে হবে দর্শকের। আর সপ্রতিভ রাজকুমারের জন্যই এই সিরিজে হয়ত উতরে গেলেন পরিচালক পুলকিত। দরবারির চরিত্রে নবীন কস্তুরিয়াকেও দর্শকদের ভালো লাগবে। তিনি এখানে কথকের ভূমিকাতেও। কিন্তু তাঁর হিন্দি সংলাপ এবং একই দৃশ্যে দরবারির সঙ্গে কথা বলার সময় স্ট্যানলির ইংরেজি সংলাপ হাস্যকর লাগে। এমন ব্রিটিশ উচ্চারণ দরবারি সব বুঝে ফেলছে আর স্ট্যানলিরও সব দেহাতি সংলাপ সহজে বুঝে ফেলার ব্যাপারটা ছেলেমানুষি হয়ে গেছে। বাকি চরিত্রদের কাঠামো ভালো করে ফুটে ওঠেনি, প্লটকে ভিত্তি করেই চরিত্ররা এসেছে আবার চলেও গেছে। চরিত্রের থেকে প্লটকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অনুজ ধরের ‘দি বিগেস্ট কভার আপ’ বইটি হল নেতাজির এই ‘অন্য’ ইতিহাসের মূল ভিত্তি। এই সিরিজের প্লটও তৈরি হয়েছে এই বই অবলম্বন করে। ডিজিটাল মাধ্যম আসার পরে এই ‘অন্য’রকম আঙ্গিকগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই চর্চা আরও বেশি করে হবে। পরিচালকের স্বাধীনতা এই মাধ্যমে অনেক বেশি, অনেক প্রসারিত, তাই বিতর্কমূলক বিষয় নিয়ে ছবি বা সিরিজ বানানোর পরিসর এখানে উন্মুক্ত।
Comments are closed.