যুদ্ধের ছবির সেই একই রকম চলন। অস্ত্র, গুলি বর্ষণ, পেশিপ্রদর্শন… যুদ্ধ বিষয়ক দেশভক্তির ছবির ট্রেলার দেখলেই হাই ওঠে হতাশায়। আর ১৫ আগষ্ট এলেই এমন থোড় বড়ি খাড়া ছবির হিড়িক। শরণ শর্মা পরিচালিত ‘গুঞ্জন সাক্সেনা-দি কার্গিল গার্ল’ ব্যতিক্রমী অনেকটাই। কার্গিল যুদ্ধে গুঞ্জনের অংশগ্রহণ, অবদান এসব তথ্য অনেকেরই জানা। কিন্তু সাহসী মেয়েদের কেবল একটাই যুদ্ধ থাকে না। তাকে প্রমাণ করতে হয় প্রতি পদক্ষেপে যে সমাজটা শুধু ছেলেদের নয়। একচেটিয়া ছেলেদের কাজ বলে কিছু হয় না। পেশা নির্বাচনের, ওড়বার, নিজের কাজকে ভালোবাসার, দেশপ্রেমের বাঁধাগতের বুলি না আওড়াবার স্বাধীনতা তার আছে। একইরকম। ছেলেদের যেমন থাকে। তাই গুঞ্জন সাক্সেনার বায়োপিক অন্য মাত্রা যোগ করে বলিউডি বায়োপিকের ভিড়ে। এই যে একটি মেয়ের নিজের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারা, নিজের ইচ্ছেকে সসম্মানে  চারপাশের সমস্ত বিরুদ্ধতার সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একচোখামিকে সরিয়ে দিয়ে স্বপ্ন দেখা ও সাকার করতে পারার সাহসকে লালন করা… এসবই তো সত্যি সত্যি এগিয়ে দেয় দেশকে, সমাজকে, মানুষকে। হাজারটা যুদ্ধ, একপক্ষ নেওয়া যুদ্ধের ছবি, দেশভক্তির লম্বা লম্বা সংলাপে ‘জোশ’ বাড়ে, কিন্তু দেশ, মানুষের রোজকার জীবন পড়ে থাকে সেই তিমিরেই। অথচ হেরে যাওয়া, লড়াই থামিয়ে দেওয়া মানুষকে প্রেরণা যোগায় এই ধরণের গল্প। 

Gunjan Saxena-Shakuntala Devi

তাই নেপোটিজম, করণ জোহর, স্টার কিডদের অনেক বকওয়াস ছবিও যখন মানুষ মাথায় তুলে নিয়েছে এতদিন, সেইসব রদ্দি ছবিকে যখন উদ্বাহু হয়ে একশো কোটি টাকার ক্লাবে পৌঁছে দিয়েছে এতদিন, বেচারা জাহ্নবী কাপুর অভিনীত গুঞ্জন সাক্সেনার এ হেন লড়াইয়ের সত্যকাহিনি মার খাবে? যদিও কোনও সন্দেহ নেই যে অন্য অনেক অভিনেত্রী আছেন যারা হয়ত অনেকখানি উৎকর্ষতার সঙ্গে এ ভূমিকা পালন করতে পারতেন।

এ দেশে মানুষ খেপে গেলে বড্ড মারমুখী হয়ে ওঠে, একতরফা হয়ে ওঠে, তাই গুঞ্জনের গল্পে খামতি হল মুখ্য ভূমিকায় জাহ্নবী কাপুর আর প্রযোজনায় করণ জোহর। প্রতিভা থাকলে তার বিচ্ছুরণ ঘটবেই সেখানে স্বজনপোষণ থাকুক আর না থাকুক। তাইতো এ ছবিতে গুঞ্জনের বাবার ভূমিকায় পঙ্কজ ত্রিপাঠির পারফরম্যান্স নিয়ে সবাই ধন্য ধন্য করছে। পঙ্কজ ত্রিপাঠি, মানব ভিজদের পাশে কতখানি ফ্যাকাশে লেগেছে মুখ্য ভুমিকায় থাকা জাহ্নবীকে, তাই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম। আর এ প্রসঙ্গেই চলে আসছে ওটিটিতে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত আর একটি বায়োপিকে বিদ্যা বালনের অভিনয়ের প্রসঙ্গ। ‘শকুন্তলা দেবী’। এমন মুখ্য চরিত্রে বিদ্যা কী করতে পারেন সবার জানা। কোনও স্বজনপোষণকে তোয়াক্কা না করে, নিজের কথা নিজের মুখে নাগাড়ে না আউড়ে, তিনি কাজে করে দেখান। আর প্রমাণ করেন যে উজান পথে চলতে হলে ব্যতিক্রমী হতে হয়, ওয়াকিবহাল হতে হয়, বিবেচনাবোধ রাখতে হয়।

সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত দুটি বায়োপিকেই মেয়েদের লড়াই অন্য আঙ্গিকের কিন্তু অবশ্যই স্বাধীন চিন্তার হক প্রতিষ্ঠা করে উভয় চরিত্র। ভীষণ অন্যরকম এক উজ্জ্বল চরিত্র শকুন্তলা দেবী। মানব কম্পিউটার হিসেবে যিনি বিশ্বে পরিচিত। ছোটো থেকে নিজেকে ব্যতিক্রমী করে তোলার লড়াইয়ে যিনি প্রবল ছিলেন তাঁকে ব্যক্তিগত পরিসরে লড়াই করতে হয় নিজের সন্তানের সঙ্গে, নিজের সংসারে তাঁকে প্রমাণ করতে হয় তাঁর মাতৃত্বের কর্তব্য, আসে অবহেলার প্রসঙ্গ। জটিল জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান যিনি এক পলকে করে ফেলতে পারেন তাঁকে পরীক্ষা দিতে হয় সেই হেজে যাওয়া নারীদের কপালে সাঁটা মহান তকমাগুলোর প্রেক্ষিতে- মমত্ব, নারীত্ব, মাতৃত্ব…। এ হেন জিনিয়াস মহিলা দেশের গর্ব, তাঁর প্রতিভা, সাহস শুধুমাত্রই সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বই লিখেছেন, জ্যোতিষ চর্চা করেছেন আরও অনেক কিছু করেছেন বৈচিত্র্যে ভরা এই মানুষটি। কিন্তু সংসার তাঁকে বাঁধতে চায় পরিচিত বন্ধনে আর তিনি মুক্ত হতে চান নিজের দিগন্তে, নিজের শর্তে। তিনিই এ দেশে প্রথম সমকামিতার ওপর বই লিখেছিলেন তখন সে বইয়ের কদর করেনি কেউ। সত্তরের দশকে এই বই নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল কিন্তু তিনি সোচ্চারে বলেছিলেন যে সমকামিতা অপরাধ নয়, সেক্সুয়াল প্রেফারেন্সকে সমাজের পরিপূর্ণভাবে মান্যতা দেওয়া উচিত। তাঁর লেখা বইটির নাম ‘দি ওয়ার্ল্ড অফ হোমোসেক্সুয়ালস’। তাঁর বায়োপিকে অবশ্য শকুন্তলা দেবীর সাফল্য এবং মা-মেয়ের দ্বন্দ্বই প্রকট হয়েছে। 

সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত দুটি ছবিরই ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। সমালোচনা করার সুযোগ আছে। গুঞ্জন সাক্সেনা-দি কারগিল গার্ল ছবিটি নিয়ে ইতিমধ্যেই আপত্তি জানিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। তারা সেন্সর বোর্ডে চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে যে, সেনাবাহিনীতে নারীর প্রতি পুরুষ সহকর্মীদের আচরণের যে তফাত দেখানো হয়েছে তাতে বায়ুসেনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

অনু মেনন পরিচালিত শকুন্তলা দেবী ছবিটিও অনেকেরই অনেকখানি বেশি নাটকীয় মনে হতে পারে। কিছু আসল ঘটনার বদল ঘটানো হয়েছে বলেও মনে করেছেন অনেকে। শৈশব যে নিদারুণ দারিদ্রে কেটেছে, পয়সার অভাবে তাঁর স্কুলে না যেতে পারা কিংবা যথাযথ চিকিৎসার অভাবে তার বোনের মৃত্যু এসব ঘটনা গুরুত্ব পায়নি এ ছবিতে। তাঁর নাম, যশ, অর্থ ব্যবহার করবে, তাঁকে শোষণ করবে তাঁর পরিবার এই শঙ্কায় নাকি তিনি বিচ্ছিন্ন করেন পারিবারিক সম্পর্ক। অঙ্কের ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে, রোজগার করার তাগিদে তার শৈশব ডানা মেলতেই পারেনি। ছবিতে দেখানো হয়েছে সমকামিতা নিয়ে বই লেখার পর মিডিয়া হাইপের জন্য তিনি স্বামীকে গে বলেছেন, এ তথ্য নিয়েও ভিন্ন মত আছে। বায়োপিক ঘিরে বিতর্ক থাকবেই। সে বিতর্ক ছবিকে এগিয়েও নিয়ে যাবে। ইতিহাস সাক্ষী।

সব কিছুর মধ্যেও ইতিহাস সাক্ষী থাকুক এসব লড়াইয়ের। স্বপ্নপূরণের। নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছামতো গড়ে তোলার স্বাধীনতা থাকুক মেয়েদের হাতেই।