এপ্রিল মাসে অকালবোধন। অন্য শরৎকাল, অন্য শিউলির গল্প (গল্প বলি কী করে? এত স্বাভাবিক সবকিছু, আসলে গল্প বললে যে শুরু, শেষ,   পেলবতা বা কর্কশতা কিংবা ঘটনার ঘনঘটা থাকা উচিত সেসব তেমনভাবে নেই তো) …তার চেয়ে বরং বলি, চলচ্ছবি আঁকলেন সুজিত সরকার।  গল্প বলা বা সমালোচনা করার ইচ্ছে খুব একটা আজ হল না। কোনও কোনও ছবি কখনো সখনো আসে তাদের একটু ছাড়ান দিতে হয়। আমার মনে হল পরিচালক  নিজেকে নিজেই ছাড়ান দিয়েছেন- ভালো-মন্দ বিচারের কাঁটাছেড়ার দায় থেকে, লক্ষ্মী – অলক্ষ্মী লাভের দায় এবারটা নেননি তিনি।
আর তাই ঢাক নেই, ধুনুচি নেই, কলকাতা বা কুমোরটুলি নেই এমনকি  প্রধান চরিত্ররা কেউ বাঙালি নন… তবু শরৎ আর শিউলি টুপ করে ঝরে পড়ল এপ্রিল মাসের ঠান্ডা মাল্টিপ্লেক্সে। শরৎ যেমন উৎসবের আনন্দের তেমনি  বিসর্জনের, বিদায়ের, অপেক্ষারও। ভালোবাসার যাত্রাপথও ঠিক তেমনি…। কখনও অপেক্ষার শেষটা অজানা, কিন্তু তেমনভাবে ভালোবাসলে অপেক্ষা করা যায়…। সুজিত এমন এক ভালোবাসার কথা বলতে চাইলেন এই আধা-বর্বর যুগে যা হয়তো শিউলি ফুলের মতোই ক্ষণস্থায়ী আর তার মৃদু গন্ধ আর স্নিগ্ধ  সৌন্দর্য সবসময়ই প্রচ্ছন্ন- সত্যিকারের ভালোবাসার মতোই।

Making of October

ছবির প্রেক্ষাপট হোটেল এবং হসপিটাল। কী অদ্ভুত মিল দুটি জায়গায়- ছবিটা না দেখলে হয়তো কোনওদিন ব্যাপারটা উপলব্ধিই করতাম না। একটিতে আপনার আনন্দ, রসনা, বাসনা, তৃপ্তি, প্রয়োজন পূরণের জন্য  বিপুল আয়োজন অনেকগুলি টাকার বিনিময়ে। আর অন্যদিকে আপনার শরীরের স্বাস্থ্যোদ্ধার, রোগের নিরাময়, আপনার যত্নের জন্য টাকার বিনিময়ে পরিষেবা গ্রহণ। দুটি জায়গায় কাজের নেপথ্যে যারা থাকেন তাদের কাজে সেই একই যান্ত্রিকতা আর একঘেয়েমি। দুই ক্ষেত্রেই কখনও ক্রেতা সন্তুষ্ট হচ্ছেন, কখনও বিরক্ত। হোটেলে বৈভব আর বিলাস, আর হসপিটালে আবাহন কিংবা বিসর্জন। বৈপরীত্যের মধ্যেও মিল। আর দুই ক্ষেত্রেই অতিথি আসে যায়… বাকি সব কিছু একই থাকে।

আরও পড়ুন: স্থূল ভাঁড়ামো আর অশ্লীল রসিকতার বাইরে বাংলা ছবিতে এখন হাস্যরস কোথায়?

ডানিশ ওয়ালিয়া উরফ ড্যান গল্পের নায়ক। প্রথমে তাঁকে আলসে, খামখেয়ালি, নিজের ভালো নিজে বোঝে না টাইপ লাগে, এই গতে এমন কোনও নতুনত্ব নেই যে ড্যানরূপী বরুন ধাওয়ান চিরকালীন একটি চরিত্র হয়ে উঠবেন, কিন্তু যখন থেকে ড্যানের স্বার্থহীন সরলতা, ভালোবসার প্রতি প্রত্যয়ী, পাগলাটে রূপটা ফুটে উঠবে তখনই ড্যানকে ভালো লাগতে শুরু করবে দর্শকের। এত স্বাভাবিক একটি চরিত্র অথচ বিরল এখন, তাই মন কাঁদবেই এমন এক বন্ধু যদি থাকত! ফরেস্ট গাম্পের টম হ্যাঙ্কসকে মনে পড়তে পারে। আবেগ, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব যে শুধু ভারসাম্য দিয়ে, হিসেব দিয়ে, পাওয়া না পাওয়া দিয়ে, লাইক, কমেন্ট দিয়ে গড়ে ওঠে না, তার মধ্যে পাগলামি, বোকামো, বেহিসেব, পরার্থতা থাকে তা এই সময়ে দাঁড়িয়ে কেমন করে বোঝাবেন আপনি, সুজিত? আর এইখানেই ছবিটির মাত্রা ভিন্ন স্তরে পৌঁছয়। যদিও ভীষণভাবে জানি যে এমন প্রেম বা বন্ধুত্ব নেই, তবু সুজিত আপনার মতো কেউ কেউ বারবার বন্ধুত্ব নিয়ে যত মূল্যবোধের, বলিদানের, দায়বদ্ধতার (আজকের দিনে হয়তো সব অচল শব্দ) পাঠ শেখান আর আবার মনের ভিত গোড়া থেকে নাড়িয়ে দেন… বিশ্বাস, সাহচর্য, ভরসা ইত্যাদি শব্দগুলো মাথায় ভর করে। শূন্যতাতেও যে পূর্ণতা থাকে সেই দর্শনকে হৃদয়াঙ্গগম করা খুব কঠিন। ড্যান তা করে অনায়াসে এবং তাও আবার নিজেকে, নিজের পেশাকে, নিজের বাড়িকে অবহেলা করে … বাকিটুকু দেখতে হলে এবং এই সব কিছুর সঙ্গে শিউলি আর অক্টোবর মাস কীভাবে জুড়ে যায় তার জন্য ছবিটা দেখতে হবে।
কোনও বাহুল্য ছাড়াই কীভাবে আবহ সংগীত জুড়ে থাকে ছবির সঙ্গে নির্ভার হয়ে তা উপলব্ধি করানোর জন্য শান্তনু মৈত্র-কে ধন্যবাদ। জুহি চতুর্বেদী আর সুজিত সরকারের যুগলবন্দি সবসময়ই সচিন-সৌরভের জুটিকে মনে করায়। অভিনেতারা প্রত্যেকে অসাধারণ। বাকি কলাকুশলীরাও ঠিক তাই… যথার্থ।  সমালোচনা করার ইচ্ছে না থাকলেও এটুকু বলতেই হল।