চলতে থাকা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের জেলা ভিত্তিক আলোচনার শেষ প্রান্তে আমরা উপস্থিত। আমাদের আজকের আলোচনা মুর্শিদাবাদ, নদিয়া আর বীরভূম জেলা নিয়ে। জেলার তথ্য নিয়ে হাজির হবার আগে, আমরা এই নির্বাচনের কতগুলি দিক তুলে ধরব, যেগুলি এই নির্বাচনের ফলাফলকে অনেকখানি ত্বরান্বিত করবে।
ক) সরকারি কর্মচারীরা কাকে ভোট দেবেন? নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটের গতি প্রকৃতি বলে দেবে সরকারি কর্মীরা কি চাইছেন। গত ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মোটামুটি অধিকাংশ লোকসভা কেন্দ্রেই ভোট কার্যে নিযুক্ত ব্যক্তিরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। নদিয়া, বীরভূম এবং মুর্শিদাবাদ জেলায় ৭টি লোকসভা আছে। ভোট কর্মীরা কে কোথায় ভোট দিয়েছেন তার একটা হিসেব তুলে ধরলাম ১ নম্বর টেবিলে। পশ্চিমবঙ্গে ১০ লক্ষ সরকারি কর্মচারী আছেন, তারা বা তাদের অধিকাংশের পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছে।
খ) মহিলা ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন? ভোটারদের অর্ধেক মহিলা, তাই তাদের ভোট ভাবনা এবার নির্বাচনী ফলাফলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ দিন ধরে মমতা বন্দোপাধ্যায় মহিলা মহলে জনপ্রিয় তার সহজ সরল জীবন, লড়াকু মেজাজের জন্য। সরকারে এসে কন্যাশ্রী, বিধবা ভাতা ইত্যাদি প্রকল্প চালু করায় মহিলারা সরাসরি উপকৃত হয়েছেন। এই নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিরোধীদের নির্বাচনী প্রচার মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অন্য অনেক স্বরূপ চিনিয়েছে। তৃণমূলের সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, নেত্রীর ভাষার ব্যবহারও বহু মহিলাকে যন্ত্রণা দিয়েছে। অন্য দিকে বিজেপি মেয়েদের সর্বস্তরের পড়াশুনা ফ্রী, সরকারি চাকরিতে ৩৩% মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করা এবং গণ পরিবহনে বিনা খরচে যাতায়াতের ব্যবস্থা করার কথা বলেছে। বিধবা ভাতা এক হাজার থেকে তিন হাজার করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। কবে থেকে বা কীভাবে দেওয়া হবে এই সব নিয়ে মানুষ চিন্তিত নয়। ডাবল ইঞ্জিন সরকারের সামর্থ্য এক পুরানো ইঞ্জিন চালিত সরকারের থেকে অনেক শক্তিশালী হবে তা বলার দরকার পড়ে না। তিন তালাক বেআইনি ঘোষিত হওয়ায়, মুসলিম মহিলারা তাদের উপরে হওয়া অন্যায় অবিচার থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, তাদের একটা অংশ ব্যালট বক্সে বিজেপিকে নিশ্চয়ই ধন্যবাদ জানতে চাইবে।
গ) কৃষকদের ভোট কাদের দিকে? পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা দীর্ঘ দিন ধরে ছিল বামেদের সাথে, তৃণমূল কংগ্রেস সেভাবে কৃষকদের মধ্যে প্রভাব ফেলেনি, যদিও এলাকা দখলের রাজনীতিতে কৃষকরাও বিভিন্ন এলাকায় শাসক দলের সঙ্গে মিশে যান। তাতে তাদের আর্থিক সুবিধা কতটা হয়েছে জানা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী কিষান সন্মান নিধি প্রকল্প সমগ্র ভারতে চালু হয়েছে ১লা ডিসেম্বর, ২০১৮ থেকে সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় বরাদ্দে। কিন্তু বাংলার কৃষকরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, রাজ্য সরকার কৃষকদের নামের তালিকা আর তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর না পাঠানোয়। বিজেপি জানিয়েছে, তারা সরকার গড়লে, কৃষকরা তাদের তিন বছরের পাওনা ১৮ হাজার টাকা পাবেন। কৃষকদের একটা বড় অংশ নিশ্চয়ই মুখিয়ে রয়েছেন এই টাকা পাওয়ার জন্য। কিষান সম্মান নিধি প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গের কত জন কৃষকের উপকৃত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তার সম্পূর্ণ তালিকা এই মুহূর্তে না থাকলেও একটা ধারণা দেওয়া যেতে পারে- উত্তর প্রদেশের ২০ কোটি নাগরিকের মধ্যে ২ কোটি ২২ লক্ষ জন কিষান সন্মান পেয়েছেন। সেই হিসেব ধরলে ১০ কোটি জনসংখ্যার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি মানুষের এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার কথা।
ঘ) সংখ্যালঘু ভোট কোন পথে? সংখ্যালঘু ভোটের বড় অংশ বাম জমানার অধিকাংশ সময় জুড়েই ছিল বামদের দিকে। কংগ্রেস সরকার দ্বারা নিয়োজিত রাজিন্দর সাচ্চার কমিটি ২০০৬ সালে ভারতে মুসলিমদের অবস্থান নিয়ে ৪০৩ পাতার একটি রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে দেখা যায়, সরকারি চাকরিতে মুসলিমরা উপেক্ষিত। ২০০৮ এর পঞ্চায়েত, ২০০৯ সালের লোকসভা এবং ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই রিপোর্টের জেরে বামেদের মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে ধস নামে। মুসলিম ভোট দক্ষিণবঙ্গে ব্যাপকভাবে তৃণমূলের দিকে চলে যায়। মালদহ, মুর্শিদাবাদে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক কিন্তু তৃণমূলের দিকে ছোটেনি। ২০১১ সালে মালদহের মানিকচক আর মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি বিধানসভা আসনে তৃণমূল জেতে। ২০১৬ সালে তৃণমূল মালদহে কোনও আসন পায়নি, মুর্শিদাবাদে চারটি আসন জেতে তৃণমূল, কংগ্রেস ১৪ আর তাদের জোটসঙ্গী বামফ্রন্ট ৪টি আসন। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ কার্যত কংগ্রেসের হাত ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কংগ্রেস এগিয়ে থাকে মাত্র ৫ টি বিধানসভা কেন্দ্রে। এবার কিন্তু মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক পুরোপুরি তৃণমূলে থাকছে না। এক অল্প বয়সী অত্যন্ত জনপ্রিয় ধর্মগুরু এক নতুন দল গড়ে কংগ্রেস আর বামেদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে , মুসলিম জনমানসে এক নতুন ভাবনার সঞ্চার করেছেন। এর ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ভোট ভাগ হবে। মুসলিম ভোটের বড় অংশ তৃণমূলে আছে কিনা এখন তাই দেখার। মুর্শিদাবাদে ২৬ টি ব্লকে মুসলিম জন সংখ্যা ৪০% এর অধিক, বীরভূমে ১১টি এবং নদিয়ার ৯টি ব্লকে মুসলিম জনসংখ্যা ৩০ শতাংশের বেশি।
যখন মুসলিম ভোট ভাগ হওয়ার দিকে, তখন তৃণমূলের বেশ কিছু মুসলিম নেতা ও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পঞ্চায়েত এবং স্থানীয় প্রশাসনের ‘আগ্রাসী’ ভূমিকায় হিন্দুদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাদের জমি জমা, ঘর বাড়ি কেড়ে নেওয়ার নানান অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসন নীরব। ফলে এই নির্বাচনে মুসলিম এলাকায় হিন্দু ভোটের মেরুকরণ ঘটছে। যার সুবিধা পাচ্ছে বিজেপি।
ঙ)বাংলার যুব সমাজ কাদের ভোট দেবেন? চাকরি না পাওয়ার জ্বালা যুব মানসে খুবই তীব্র। ২০১৭ সালে রাজ্য সরকার ৬,০০০ গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয়, তাতে ২৫ লাখ চাকরি প্রার্থীর আবেদন জমা পড়ে, কেউ চাকরি পেয়েছে কিনা জানা নেই। স্কুল সার্ভিস কমিশন দীর্ঘ দিন চাকরি দেয়নি, বিজ্ঞাপন দিয়েছে। চারিদিকে হাহাকার! ন্যাশনাল স্যামপেল সার্ভের ২০১৭ পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে রিপোর্টে বলছে, পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট প্রাপ্তদের ২৯.২% বেকার, স্নাতকদের ১২%, স্নাতকোস্তরের ১৩.৭%, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করাদের ৮.২%, মাধ্যমিক পাশ করাদের ৬.৫% বেকার। এছাড়াও দেখা যাচ্ছে, ১৮-২৩ বছর বয়সীদের ২৫.৮% গোটা দেশে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, পশ্চিমবঙ্গে সে্খানে সংখ্যাটা ১৮.৭%। ফলে যুব মানসের যন্ত্রণা অনুমেয়। ৭০-এর দশকে বামপন্থা যুব সমাজকে আকর্ষিত করেছে, কিন্তু এখন আর তা সেভাবে আকর্ষিত করে না। সবাই বোঝে দেশের আর্থিক অগ্রগতি হলেই শ্রমের চাহিদা হয়, যুবকরা সেই দিকেই তাকিয়েই এবার ভোটদান করছেন।
চ) বস্তির ভোট কোন দিকে যাবে? ২০০১ সালের সেনশাস অনুযায়ী কলকাতার ৮% মানুষ বস্তিতে থাকেন। তৃণমূল শাসনে বস্তিতে পুরসভার পরিষেবা আগের থেকে অনেক ভাল, বিদ্যুৎ, পানীয় জলের সংযোগ হয়েছে, শৌচাগার তৈরি হয়েছে। তাদের ক্লাবগুলি নানান সরকারি অনুদান পেয়েছে, যা আগে ছিল না। যে ২০-২৫ লাখ মানুষ বস্তিতে থাকেন, তাদের ভোটাররা এবারও তৃণমূলের সঙ্গে থাকবে বলা যেতেই পারে। এরাই দলের সংগঠনটাকে ধরে রেখেছে। কলকাতার এই সব অঞ্চলে অন্য দলের দাঁত ফোটানো বেশ কষ্টকর।
ছ) সংযুক্ত মোর্চা কতোটা ভোট টানবে? কংগ্রেস মুর্শিদাবাদ ও মালদহে, সেকুলার ফ্রন্ট উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কয়েকটি সিটে এবং নিজ মহিমায় জনপ্রিয় কিছু বাম নেতা (যেমন , সুজন চক্রবর্তী , অশোক ভট্টাচার্য ,কান্তি গাঙ্গুলী ,তন্ময় ভট্টাচার্য ,মহম্মদ সেলিম) ছাড়া অন্যত্র তাদের জেতার আশা ক্ষীণ। প্রতি বিধানসভায় দেড় থেকে দুই লাখ ভোট পড়ে, ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে গেলে ৫০ থেকে ৭০ হাজার ভোট পাওয়া জরুরি। টেবিল ৪ থেকে স্পষ্ট, খুব কম জায়গায় বামেরা সেই অবস্থায় রয়েছে ২০১৯ লোকসভা ভোটের প্রাপ্তি বিচারে। এখনও সেই অবস্থা পাল্টায়নি ২০১৯। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ২৯৪ আসনের জেলা ভিত্তিক সমষ্টিবদ্ধ পাঁচটি আলোচনায় আমরা ছিলাম। এবার দেখব কে কটা আসন পেতে পারে-

টেবিল ১ : সরকারি কর্মীদের ভোট কোন দিকে কত ( নদিয়া ,মুর্শিদাবাদ আর বীরভূম ) –

টেবিল ২ : মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং বীরভূমে ২০১১, ২০১৬, ২০১৯ -এর নির্বাচনী ফলাফল


টেবিল ৩: মোট জনসংখ্যার শতাংশ হিসাবে নদিয়া, মুশির্দাবাদ এবং বীরভূমে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা

টেবিল ৪ : বিভিন্ন কেন্দ্রে বামপ্রার্থী এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোট

Comments are closed.