“আপ যা তো সকতে হ্যায়, পর ওয়াপস নেহি আ পায়েঙ্গে।” – রাস্তার ব্যারিকেডে পাহারায় থাকা জওয়ানটি বলল। কথাটা শুনে আঁতকে উঠলাম। বলে কি? পরশু আমাদের ফিরতেই হবে, না হলে ট্রেন মিস করব।

বিপদ শুরু থেকেই। মানালি এসেছি পারাংলা ট্রেক যাব বলে। কাজা’র যে ব্যক্তির ওপর ‘মিউল’ জোগাড় করার দায়িত্ব ছিল, তিনি গত চার মাসে আমদের জানাতে পারেননি যে এই সময় পারাংলা যাওয়া মুশকিল। আমরা সব জোগাড় করে মানালি পৌঁছানোর পর সেদিন রাতে তিনি ফোনে খবরটি জানালেন। আগে এই পাহাড়ের লোকেরা আমাদের বন্ধু ছিল। এই এজেন্সি তৈরি হওয়ার পর থেকে এরা দুনম্বরি হতে শুরু করেছে। আর ভালো মানুষ যখন খারাপ হয় তখন সে মাত্রা রাখতে পারে না। পাহাড়ি এই মানুষদের এখন তাই হয়েছে।

ধান ভাঙতে শিবের গীত হয়ে গেল। তো সেই পারাংলা ট্রেক বাতিল হওয়াতে, হাতে অনেকটা সময়। স্পিতি-কিন্নর সার্কিট ঘোরার পরও তিন দিন বেশি থাকায় এসেছি বিয়াস কুন্ড ট্রেক করতে। সকালে মানালি থেকে আট’টার বাস ধরে সোলান ভ্যালি। বাস নামিয়ে দিল মেটাল রোডের ধারে একটা ভাঙাচোরা জায়গাতে। সেই মেটাল রোড ধরে কিছুটা এগোলেই সোলানের বিখ্যাত স্কি জোন। এখন যদিও ঘাসে ছাওয়া। আর রোডের ওপরেই মিলিটারি ব্যারিকেড যেখানে ওই কথা শুনতে হল।

পরে যা হবে দেখা যাবে, এই মনোভাব নিয়ে হাঁটা দিলাম দুন্ডির দিকে। ওখানেই টানেলের কাজ চলছে। অক্টোবর এর ১৫ তে রোতাং পাস খাতা কলমে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বরফ পড়লে তো পুরোই বন্ধ। সেই সময় লাহুল ভ্যালি ও লাদাকের সাথে সহজে যোগাযোগের জন্য এই টানেল তৈরি হচ্ছে। টানেলেটি দু’দিক থেকে তৈরি হয়ে এসেছে, পরশু দুটিকে জোড়া হবে। তাই সেনাবহিনীর মান্যবর অতিথিরা আসবেন। ফলস্বরূপ, “আপ যা তো সকতে হ্যায়, পর ওয়াপস নেহি আ পায়েঙ্গে।” পুরো রাস্তাই নাকি থাকবে মিলিটারি প্রোটোকল-এর অধীনে। নেতা আর মন্ত্রীদের জন্য সাধারন মানুষ হয়রান হবে। এটাই আমাদের নবীন ভারতের নীতি।

দুন্ডি অবধি অনেকটা রাস্তাই মেটাল রোড ধরে হাঁটা। তাই চড়াই প্রায় নেই। সোলান থেকে আট কিলোমিটার দুন্ডি। রাস্তায় কনস্ট্রাকশানের অনেক গাড়ি যায়, চাইলে লিফট পাওয়া সম্ভব।

রোডসাইড চায়ের দোকানে চা খেয়ে, একটি মেকশিফট ব্রিজ দিয়ে সামনের নালা পার হয়ে শুরু হল বখরতাজ-এর রাস্তা। এখান থেকে হালকা চড়াই শুরু। ২৮৪০ মিটার থেকে আমরা যাব ৩২৭০ মিটারে। তবে সেটা চার কিলোমিটার রাস্তা ধরে। তাই বুকে হাফ ধরানোর মতো চড়াই নেই কোথাও। বখরতাজ কথাটা এসেছে ‘বখরি’ থেকে। এই পুরো উপত্যকাই চারণভূমি। চারদিকই সবুজ। দু’পাশের পাহাড়ের গা ঢাকা সবুজ ঘাসের কার্পেটে। মাঝে মাঝে পাইন ফার’এর জঙ্গল। সবার পেছনে মাথায় বরফের মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছে হনুমান টিব্বা। পথে মাঝে মাঝেই দেখা হবে ভেড়া ছাগল নিয়ে চলা গদ্দিওয়ালার সাথে। তবে এখন তারা ফিরে যাচ্ছে। এই মাঝ অক্টোবর থেকে ওপরে ঠাণ্ডা বাড়বে আর ঘাস পাতা সবই শুকিয়ে যাবে।

bakhartaj
বখরতাজে তাবুর মেলা। ছবি: শুভদীপ দেবনাথ।

আমরা ঘণ্টা দুই এর মধ্যে চলে এলাম বখরতাজ। এখানে ‘মানালি মউন্টেনারিং ইনিস্টিটিউট’-এর কোর্স হয়। এখনও কোর্স চলছে। তাদের প্রচুর তাবু রয়েছে। আমরা পড়লাম মুশকিলে, আমাদের তাবু ফেলার জায়গাই নেই। আরেকটু ওপরের দিকে একটা জায়গা ছিল কিন্তু সেখানেও এক বিদেশী টিম তাবু ফেলেছে। বেলা পড়ে যাওয়াতে উপত্যকাটা মেঘ ছেয়ে ফেলেছে। সাথে হালকা বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। বিপদ বাড়ার মুখেই বিপদ কাটল। এই কোর্সে তাপনদার এক পরিচিত ইন্সট্রাক্টার পাওয়া গেল। আমরা ওনাদের কোর্সের তাবুর জায়গাতেই তাবু পাতলাম।

বিকেলে চিড়েভাজা দিয়ে টিফিন, সাথে গরম কফি সহযোগে জমিয়ে আড্ডা। বাইরে হাওয়া চলায় স্টোভ ধরানো হল টেন্টের ভেতরেই। রাতের ডিনার হল ম্যাগিতেই।

পরেরদিন সকালে কফি আর বিস্কুট দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে রওয়ানা দিলাম বিপাশার উৎস ‘বিয়াস কুন্ড’ এর দিকে। দূরত্ব খুব বেশি নয়, মাত্র তিন কিলোমিটার। উচ্চতাও বেশি নয়, ৩৬৯০ মিটার। কিন্তু বখরতাজ থেকে একটা প্রায় হাজার ফুটের রিজ পার হতে হবে। তারপর একটা বোল্ডার জোন পার হয়ে নামতে হবে বিয়াস কুন্ডের ভ্যালিতে। তাই আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাঁটা শুরু করলাম।

প্রথমে নালার ধার ধরে রিজ টপে পৌঁছাতে দম লাগল বটে কিন্তু ভয়ের কিছু ছিল না। কিন্তু বোল্ডার জোনে পৌঁছে হল মুশকিল। রাস্তার কোনও ‘ডিমার্কেশন’ না থাকায় সবাই নিজের মতো করে রাস্তা নিতে শুরু করল। ফলে অনেক ঝামেলা করে, অনেক রাস্তা ভুল করে, সময় নষ্ট করে জায়গাটা পার হলাম। নেমে এলাম বিয়াস কুন্ড ভ্যালিতে।

অনেক নালা গিয়েছে এই ভ্যালি দিয়ে। অক্টোবর মাস হওয়াতে নালা অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। সেটা আমাদের চলার জন্য সুবিধে হল ঠিকই কিন্তু অন্য সময় যে ফুলে ঢাকা থাকে সেটা পেলাম না। সবুজ শুকিয়ে অনেকটাই রুক্ষ হয়ে উঠেছে। তবে এও প্রকৃতির আরেক রূপ।

Biyas Kund
বিয়াস কুন্ড। ছবি: শুভদীপ দেবনাথ।

জেগে থাকা নালাগুলো পার হয়ে পৌঁছে গেলাম বিয়াস কুন্ডের ধারে। সে কিন্তু তার পান্না সবুজ জল নিয়ে একই অপরূপ রূপে উদ্ভাসিত। বর্ষার সময় থেকে জলের পরিমাণ হয়ত কম কিন্তু তাতে তার কোনও সৌন্দর্যহানি হয়নি। আমরা কেউ বসলাম কুন্ডের ধারে। কেউ তার পাশের একটা ধার দিয়ে আর কিছুটা ওপরে উঠে গেল পাখির চোখে বিয়াস কুন্ডকে দেখবে বলে। আসলে এখন বিয়াস কুন্ড আমাদের কাছে প্রেমিক বা প্রেমিকা। সবাই তার সাথে নিজের মতো করে সময় কাটাতে চাইছে।

হয়ত বলতে চাইছে “ তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মুহুর্ত’রা কে জানে কি আবেশে দিশেহারা… ”