কোভিডের সঙ্গে লড়াইতে একেবারে অকালে চলে গেলেন এক কল্পবিজ্ঞান লেখক, কল্পবিজ্ঞান চর্চাকারী, পদার্থবিদ, বহুদিনের বন্ধু, দাদা, পথ নির্দেশক।
অনীশ দেব (২২ অক্টোবর ১৯৫১-২৮ এপ্রিল ২০২১)তাঁর নিজস্ব আশ্চর্য প্যাশান নিয়ে কল্পবিজ্ঞানের মশাল জ্বেলে রেখেছিলেন এই এতগুলো বছর। কী প্রবল প্রাণশক্তির মানুষ তিনি। সত্তর বছর বয়সে এই চলে যাওয়া মেনে নিতে পারিনি। আরও অন্তত কুড়ি বছর তাঁর হাত থেকে পাওয়া যেত কত না লেখা, কত কত রহস্য কাহিনি আর কল্পবিজ্ঞান কাহিনি।
আশির দশকের শেষ দিক তখন। আমাদের বাড়িতে বেল বাজল। দরজা খুলে জানা গেল অনীশ দেব নামে এক তরুণ পদার্থবিদ আমাদের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে ধাওয়া করে এসেছেন। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সের মেডেল পাওয়া ছাত্র তিনি। ১৯৬৮ সাল থেকে লেখালেখি করেন। গবেষণা করেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে। অনেক কষ্টে তিনি খুঁজে পেয়েছেন কল্পবিজ্ঞান লেখক দিলীপ রায়চৌধুরীর বাড়ির ঠিকানা। মায়ের সঙ্গে বিশাল এক আড্ডা দিলেন অনীশদা সেদিন। পুঙক্ষাণুপুঙ্ক্ষ ভাবে তথ্য দিয়ে তুলে ধরেছিলেন ষাট দশকের কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস, যা তাঁর কন্ঠস্থ। প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিত রায়, অদ্রীশ বর্ধনদের উৎসাহে তৈরি ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার কথা যা, অদ্রীশ বাবুর অসামান্য উৎসাহে চলেছিল বেশ কিছু বছর। এবং দাগ কেটে ছিল জনমানসে। এই সব ইতিহাসের ভেতরে আমার বাবাও জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায় সেই কলম ৬৬ সালে। ‘আশ্চর্য! ’ পত্রিকাতেই বেরুনো দিলীপের বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়েছিলেন অনীশদা, যখন তাঁর নিজের বয়স ১৫-১৬ মাত্র। সেগুলো তাঁর মানসে এতটাই দাগ কেটেছিল যে এই বিশাল ডিটেক্টিভগিরিটি তিনি করে ফেলেন।
অনীশদা মায়ের সঙ্গে কথা বলে এক কল্পগ্রন্থ সংকলনের জন্য অনুমতি নিয়েছিলেন বাবার একটি গল্প পুনর্মুদ্রণের। সেই সময় আমি সদ্য কলেজ পড়ুয়া। সেই দিন থেকে সাম্প্রতিক কাল অবধি অনীশদার সঙ্গে এক দীর্ঘ কালের সম্পর্ক।
পরে সেই বইটি তিনি সযত্নে পাঠান আমাদের বাড়িতে। তারও পরে নিয়মিত কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, শুকতারা, কিশোরভারতী, সর্বত্র বেরুতে দেখি অনীশ দেবের লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্প। এরপর দেখি অজস্র রহস্য ও হরর জঁরা-র গল্প উপন্যাসও লেখেন তিনি। আজ বইবাজারে তাঁর অজস্র বই, বেশ কিছু বই বেস্ট সেলার তার মধ্যে। তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট, ঘাসের শীষ নেই, সাপের চোখ, তীরবিদ্ধ, জীবন যখন ফুরিয়ে যায়, সামান্য কয়েকটা নামকরা বইয়ের নাম এখানে করলাম। নানা ঘরানার লেখা লিখলেও কিন্তু আমার কাছে অনীশদা’র একমাত্র পরিচয় থেকে যাবে অসামান্য এক কল্পবিজ্ঞান প্রেমী ও কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসেবে। অসংখ্য বইয়ের সম্পাদনা করেছেন অনীশ দেব। কেন না তাঁর পড়ার পরিধি ছিল বিশাল, ও ভাল গল্প মনে রাখার ক্ষমতা ও প্রায় গল্প করে বলার মতো। এসবেই শেষ না। বাংলায় সহজ ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস রচনার প্রয়াস তিনি করেছিলেন, ইউ এফ ও নামে একটা কলামে প্রায় চেটেপুটে গিলে খেতাম সংবাদ প্রতিদিন রোববারের তাঁর সেই কলাম, ২০১৩-১৪ নাগাদ। যেখানে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস শুধু না। ইংরেজি কল্পবিজ্ঞানের গমনপথও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। আর যা করেছেন অনীশদা, অজস্র মানুষকে কল্পবিজ্ঞান লেখার উৎসাহ দিয়েছেন তিনি।
এই পৃথিবীতে খুব বিরল এই শেষ গুণটি। লেখকদের অনেকেই অসামান্য লেখেন এবং নিজের লেখার ভিতরে মসগুল থাকেন। খুব সামান্য কয়েকজনই হয়ত পারেন, চারিপাশের অন্যদের ফ্রেন্ড গাইড ফিলোজফার হয়ে উঠতে সেটা অনীশদা পারতেন। বইমেলায় প্রতিবছর অনীশদার সঙ্গে দেখা হত। এক স্টল থেকে আরেক স্টলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। সঙ্গে কোনও না কোনও তরুণ লেখক। এভাবেই একবার আমাকে আলাপ করিয়ে দিলেন ব্রিটেনের বাসিন্দা অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর সঙ্গে। যিনি নিজেই খুব নামজাদা কল্পবিজ্ঞান লেখক এখন। আমাদের বন্ধুবৃত্তে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, সন্তু বাগ, বিশ্বদীপ দে, দীপ ঘোষ, এদের সবার সঙ্গে অনীশদার এই সম্পর্কটা ছিল। এক অসম্ভব উদারচরিত দাদা, যাঁর সদা উৎসাহ নতুনদের লেখা পড়তে ও নতুন লেখার ব্যাপারে তাগাদা দিতে। অনীশদার কর্মস্থল, শেষের বহু বছর ছিল রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। ফলিত পদার্থবিদ্যার সেই ঘরটি সম্ভবত অবসরের পরেও তাঁর ছিল। সেখানেই আমি বহুবার গিয়েছি নানা কারণে।

কল্পবিজ্ঞানের যে জোয়ার প্রথম ‘‘আশ্চর্য!’’
পত্রিকার সঙ্গে অদ্রীশ বর্ধনের ওয়ান ম্যান ইনস্টিটিউশনের সুবাদে এসেছিল, উইলারে, ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডে ‘আশ্চর্য! ’কে দেখার বিস্ময় ও আনন্দ, পাঠকমহলে রীতিমতো সাড়া ফেলে, অসংখ্য নতুন লেখক উঠে আসে। অদ্রীশদার স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। পরে আবার আশির দশকে অদ্রীশ বর্ধন চালু করেন ‘ফ্যান্টাস্টিক’ বলে আরেকটি পত্রিকা। অনীশদার ক্ষোভ ছিল এরকম আরও পত্রিকা কেন বাংলায় এল না। পরে রণেন ঘোষ সম্পাদিত বিস্ময় পত্রিকা এসেছিল। তবে সেভাবে বড় পত্রিকা আর ছিল না। কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান ছিল কিছুদিন। পরে শুকতারা, আনন্দমেলা, কিশোরভারতী মূলত এই পত্রিকাগুলিতেই কিশোর পাঠ্য কল্পবিজ্ঞান বেরুত। অনীশদার লেখালিখি এইসব পত্রিকাগুলোকেই কেন্দ্র করে, কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা বিপুল হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞান বিষয়ে বেশ কিছু বই তিনি লিখেছেন, বিজ্ঞানের দশদিগন্ত বা হাতেকলমে কম্পিউটার বইগুলি তারই স্বাক্ষর। অনীশ বলতেন, কল্পবিজ্ঞান লিখতে তিনটে জিনিস লাগবে। বিজ্ঞান জানতেই হবে। ব্যাড সায়েন্স দিয়ে কখনও গুড সায়েন্স ফিকশান হয় না। কিন্তু বিজ্ঞানের শুকনো কচকচি দিয়ে সাই ফাই হয় না। তাই দ্বিতীয় দাবি হল লেখকের কল্পনাশক্তি। এই বস্তুটিই আসল। তৃতীয় উপাদান ভাষাজ্ঞান, ভাষাবোধ, প্রচুর পড়ার অভ্যাস ও নিজের হাতে লিখতে লিখতে ভাষাকে আয়ত্ত করা। ভাষাকে তিনি সরস্বতী বলতেন। সুন্দর কাব্যিক ভাষা ব্যবহার দেখলে বাহ বাহ বলে উঠতেন, মনে আছে। বড় লেখকের হাতে পড়ে বিজ্ঞানের সামান্য ভুল থাকলেও অসামান্য কল্পবিজ্ঞান গল্প রচিত হয়েছে একথা বারবার উদাহরণ দিয়ে বলতেন অনীশদা। তাঁরা গল্প লিখেছেন প্রসাদগুণে, কব্জির জোরে। অনীশদাও বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান গল্প যে কটি লিখেছেন তাতে এই জানিস পাব। একটা ছোট বৈজ্ঞানিক প্রিন্সিপল বা নীতিকে ঘিরে বোনা ঠাশবুনোট গল্প। এক বৈজ্ঞানিক জীবনদর্শন আর সরস জীবন-আনন্দ (joie de vivre) সবগুলিতেই আমরা পাই প্রতিটি কল্পবিজ্ঞান গল্পে কল্পনা তো থাকেই। কিন্তু এক আধটা যু ক্তি গ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক প্রিন্সিপল বা আদর্শ থাকে।
বিজ্ঞানর সফল ছাত্র ও সুশিক্ষক, লেখালেখিতে নিবেদিত প্রাণ অনীশ দেবের লেখাগুলি থেকে গেল। ২০১৯-এ তিনি বিদ্যাসাগর পুরস্কার পেয়েছিলেন। আরও অনেক পুরস্কার তাঁর প্রাপ্য ছিল। তাঁর জীবনে আরও অনেক পরিকল্পিত কাজই হয়ত অপূর্ণ রয়ে গেল। মারণ ভাইরাসের ঢেউ আর কত জন সরস্বতীর বরপুত্রদের কেড়ে নেয় কে জানে!