কিছু কিছু পংক্তি কালজয়ী হয়, অমলকান্তিকে চিনতাম না তখন, জানতাম না যে সে রোদ্দুর হতে পারেনি, অমল কারও নাম হলেই বড়রা তাকে মজা করে জিগ্যেস করত “তুমি কি রোদ্দুর হতে চেয়েছিলে?” পরে জেনেছিলাম অমলরা রোদ্দুর হতেই চায়, অমলকান্তির মতো আরও এক অমল তাই চেয়েছিল, দইওয়ালা না হতে পারার আফশোস তার মরমে মরমে। রোদ আর জানলার বাইরের পৃথিবীটাকে ছুঁয়ে দেখতে পারার সুখটুকুই তাদের সম্বল। রোদ্দুর হতে পারার যে রোমাণ্টিসিস্মে আচ্ছন্ন ছিলাম কেবল ঐ একটা লাইন জেনে, গোটা কবিতাটা পড়ে কিন্তু বিষণ্ণতাই সম্বলও হল। তাও ঝরঝরে, দীপ্ত সটান রোদ উঠলেই অমলকান্তির ইচ্ছের কথাই মনে পড়ে।
ক্লাস ইলেভেনে পড়তে স্কুলে গল্প লেখার প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছিলাম, পুরস্কার পেলাম, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার বই। কবিকে কেমন নিজের মনে হল! ভারি ভারি শব্দ নেই, না বুঝতে পারার মতো তেমন কিছু নেই তো! অথচ কী সুন্দর কবিতা। রোজকার কথা, রোজকার দৃশ্য, সহজ বয়ে যাওয়া…।
তারপরের মুগ্ধতাও একটু বড় হয়েই… হ্যাডকের মুখে অলম্বুশ, নরখাদক, হোঁদলকুতকুত, বকচ্ছপ, জলের পোকা গালিগুলো পড়ে একা একাই হিহিহি, আর নতুন পাওনা গয়নার মতো কাউকে কাউকে সেসব গালিতে ভূষিত করার পৈশাচিক আনন্দ! এত সরস অনুবাদ কার? তাঁর! সঙ্গে নাকি লীলা মজুমদার! আর মহাপাজিক্স, এটাসেটামিক্স বা বিশলাকৃতিক্স এমন সব মানানসই নাম ও গল-রোমানদের বঙ্গ-বিজয়ও নাকি তাঁদের হাত ধরেই হয়েছিল! আমাদের আনন্দমেলার সময়টাতেই তো তিনিই সম্পাদক। সেসব জানলাম আরও একটু বড় হয়ে …। তারপর চার্লস চ্যাপলিনের যে জীবনী (আর জে মিনির লেখা) পড়লাম তাও তো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুবাদ… ব্যাস মুগ্ধতা বাড়তেই লাগল…।
সেই মানুষটার চলে যাওয়া মানেই মুগ্ধতা দ্বিগুণ হয়ে গেল এমন নয়। নীরেন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ যিনি ঘিরে আছেন শুধু কবিতায়, বানানে, ব্যাকরণে নয়… নানান দিক দিয়ে, নানা বিষয়ে… তাই স্মরণের সঙ্গে কেবল মুগ্ধতা, বিস্ময়টুকুই থেকে গেল আমার কাছে… ।
“ …এ-রকমই হয়, এ-রকমই হয়ে থাকে,
মানো আর না-ই মানো
খড়কুটো ছাড়া থাকে না কিছুই আর।
অগত্যা তা-ই সিন্দুকে তুলে রাখে
মানুষের সংসার।”
(খড়কুটো)