‘রেনবো জেলী’র ট্যাগ লাইন যে আশার কথা বলে, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে উঠবার মূলমন্ত্র। “সব রূপকথা মিথ্যা হয় না”- এই বিশ্বাসই মানুষকে তার চরম প্রতিকূল অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে। এইখানেই ‘রেনবো জেলী’ একটি সার্থক সৃষ্টি হয়ে ওঠে।

রূপকথা কি শুধুই আজগুবী উপাখ্যান, যার থাকে গোঁজামিল দেওয়া এক শুভ পরিণতি? রূপকথা আসলে একটা স্বপ্ন, যা আমরা দেখতে ভুলে গেছি, ভুলে যাই, দৈনন্দিন জীবনের ওঠাপড়ার সঙ্গে লড়তে লড়তে।

ঘোঁতনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, সংগ্রামকে আরও কঠিন করে দেয় তার গণ্ডারিয়া মামার দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার। যার উদ্দেশ্য ঘোঁতনের সমস্ত সম্পত্তি কুক্ষিগত করা।

পরীপিসির আবির্ভাব এই গল্পকে রূপকথা বানিয়ে দেয় সব অর্থে। ঘোঁতনকে সে স্বপ্ন দেখায় এক স্বাধীন, সার্থক জীবনের, যার থেকে এই অনাথ শিশুটি এতকাল বঞ্চিত ছিল। বিভিন্ন রঙ ও স্বাদের ব্যবহার যেন প্রতীকী হাতিয়ার এই অলিখিত, অসম যুদ্ধের।

মস্তিষ্কের কোষের মধ্যে যে বিভিন্ন স্বাদের প্রক্রিয়া চলে, তার ফলস্বরূপ মানুষের ব্যবহারিক প্রতিক্রিয়ার তারতম্য ঘটতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে, এই ছবিটি আমাকে অনুপ্রাণিত করল এ’বিষয়ে আরও জানতে।

‘টপ শটস্’-এর ব্যবহার হ্যারি পটারের ফিল্মের দৃশ্য মনে করাল। অনাথ শিশুর দমবন্ধ করা জীবনের দুঃখও আকাশ থেকে দেখলে ক্ষুদ্র হয়ে যায়, দর্শক হাঁফ ছাড়ে কারণ, তখন ঘোঁতনের সুখ দুঃখ তাদের হয়ে গেছে।

দাগ ধরা দেওয়াল, সরু সিঁড়ি, বাড়ির দালান, ছাদ, এ সবই যেন এই ছবির চরিত্র হয়ে যায়।

দুঁদে অভিনেতারা, যেমন কৌশিক সেন, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র দর্শকের মনে এই ছবির চরিত্রের নামেই থেকে যাবেন বহুদিন, আর ক্ষুদে অভিনেতা মহাব্রত বসু অনুপ্রেরণার বোধ হয়ে থেকে গেলেন সবার মনে। পপিন্স ওরফে অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মন-ছোঁয়া অভিনয় করলেন ।

পরিচালক সৌকর্য ঘোষালের স্ক্রিপ্ট দর্শকের মনযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে নিপুন ভাবে। শিশুদের দিয়ে তিনি যে কাজ করিয়েছেন, তার মধ্যে প্রশিক্ষণের ছাপ স্পষ্ট।

সঙ্গীত ও সুরের ব্যবহার ছবিটির আরেক সম্পদ। ছবির গতি, ছন্দের সঙ্গে এক সূত্রে বাঁধা পড়ে এর সুর, গান।

যারা মনে করেন ছবি’র বা যেকোনও work of art-এর একটা দায় আছে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার, তাকে মানসিক ভাবে পুষ্ট করে তোলার, যাতে সে সদর্থক ভাবে একজন মানুষ বলে পরিচিত হতে পারে, তারা এই ছবিটি দেখে হতাশ হবেন না।

Victor Frankl-এর লেখা বই ‘Man’s search for meaning’ মনে করাল এই ছবি। Holocaust survivor এই ডাক্তার মনোবিজ্ঞানের এক প্রশাখা- ‘logotherapy’র জনক। Logo(in latin)অর্থে meaning, মানে আরোপণ-এর বিদ্যা বলা যেতে পারে এটিকে। প্রধান চরিত্রের জীবনযুদ্ধ দেখতে দেখতে আমি যেন তার হয়ে মানে খুঁজে গেছি যতক্ষণ না সে রাজপুত্র হয়ে জিতে যায়। আর সে জয় শুধু তার একার নয়, প্রান্তিক হওয়ার বোধ-এ থাকা সকলের।

মাস্টার-মশাই হাব ভাব না রেখে এই ছবি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখে, যাকে বলা যেতে পারে ‘take-home message!’ রূপকথা ও বাস্তব জীবনের প্রভেদ ভেঙে ফেলা এই ছবি শিশু ও বড়দের প্রত্যেকের জন্যেই সে বার্তা রাখে।

আপনার ‘take-home message’টি কি হতে পারে সেটি খুঁজে পাওয়ার দায়িত্ব আপনার, সঙ্গের মজাটাও!