ভারতের স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্ণ, ৭১’এ পা। স্বাধীনতা দিবসের সকাল – দেশের কথা স্মরণ, পতাকা তোলা, দেশাত্মবোধক গান, মিছিল, মিষ্টিমুখ দিনটাকে বিশেষ অর্থবহ করে। আজকাল প্রায় রোজই খবরের কাগজ খুলে চোখ রাখতেই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী পাচার নিয়ে হেডলাইনগুলো মাথা হয়ে মনে নেমে আসে। সেই সবের সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্ন মনে ভীড় করে। সেইসব প্রশ্ন সামনে রেখে স্বাধীনতার ৭১ বছরে ভারতবর্ষের মেয়েদের পাওনার ঝুলিটা একবার দেখে নেওয়া যেতেই পারে।
ভারতবর্ষে মেয়েরা তাই পান যা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তাদের পাইয়ে দিতে চায়। সে মনুর সময়কাল হোক বা ঔপনিবেশিক শাসনকাল। অনেকে বলেন প্রাচীন বা মধ্য থেকে ঔপনিবেশিক কাল অনেক ভালো। তবে তা নিয়ে সংশয় রয়েই যায়, ইংরেজরা ভারতীয়দের জন্য ততটা সুযোগ দিলেন, যা থেকে তারা নিজেরা লাভবান হতে পারলেন। ইংরেজরা ভারতে মেয়েদের অবস্থা তুলে ধরে ভারতীয় আবেগে বারবার আঘাত করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।  রক্ষণশীলদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকারি উদ্যোগের পশ্চাতে প্রায় সর্বক্ষেত্রে শিক্ষিত-প্রগতিশীল ভারতবাসীর আগ্রহও দেখা গিয়েছিল। সরকারি চেষ্টায় সতীদাহ বন্ধ হল ঠিকই, কিন্তু বহুবিবাহ রোধ বা সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার অরক্ষিতই রইল, রমরমিয়ে চলল পণপ্রথা, বেড়ে গেল নিয়মের কড়াকড়ি। বিধবার বিবাহ হল শাস্ত্রীয়-শর্ত মেনে, শর্তানুসারে যেই বিধবার বিবাহের আয়োজন হল, তার মান গেলেও বিবাহই হল পরম প্রাপ্তি। পাশ্চাত্যের অনুপ্রেরণায় প্রগতিশীল ভারতীয় তথা বাঙালিরা মনে করলেন ‘আদর্শ জীবনসঙ্গিনী’ হতে  লক্ষ্মীর পাশাপাশি সরস্বতীর গুণাবলী থাকা প্রয়োজন – তাই শিক্ষা লাভের সুযোগ পেলেন গৃহবন্দী মহিলা। উনিশ শতকের প্রতিকূলতা পেরিয়ে গৃহস্থ্ বাড়ির চৌকাঠের বাইরে পা রাখলেন মেয়েরা, বিংশ শতকের শুরুতে গুটি পায়ে রাজনীতিতে আসলেন। কিন্তু তাতেও বাধা আসল প্রায় সমস্ত স্তর থেকেই। নব্য পিতৃতন্ত্র মেয়েদের বাইরের জগতে আসার সুযোগ দিলেও, রয়ে গেল বিধিনিষেধের কঠোর বেড়াজাল।
দেশ স্বাধীন হল আমরা ইংরেজ সরকারের নাগপাশ থেকে মুক্ত হলাম। কিন্তু মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করল ব্রিটিশ শাসনের কালো ছায়া। একবিংশ শতকে ফেসবুক, হোয়াটস্‌অ্যাপ-এ মেয়েদের বিচরণ সরগর হল, প্রসাধনী বা সাজপোশাক সবেতেই আধুনিকতার চমক- কিন্তু এসব পক্ষান্তরে মেয়েদের জীবনকে গতানুগতিক পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কঠোরভাবে আবদ্ধ করে ফেলে।  IHDS (Indian human development Survey) র দেওয়া এক তথ্য অনুসারে, ২০০৪-২০০৫ এবং ২০১১-২০১২ র মধ্যে ভারতে মাত্র ৪.৯৯% মহিলা নিজের পছন্দ করা পাত্রকে বিবাহ করেছেন। অন্যদিকে বাড়ির বাইরে, এমনকি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে ৭৯.৮% মহিলার বাড়ির লোকের সম্মতি প্রয়োজন হল। শুধুমাত্র ২০১২ ‘র IHDS র সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৫% মহিলা নিজেই নিজের স্বামী নির্ধারণের স্বাধীনতা পাচ্ছেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে ৬৫% মহিলা বিয়ের দিন প্রথম জীবনসঙ্গীর মুখ দেখার সুযোগ পান। অর্থাৎ যার সঙ্গে বাকী জীবন থাকতে হবে তাকে বিয়ের আগে দেখার সুযোগ অধিকাংশ মহিলার থাকে না। শুধু ওই বছরেরই প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেল- ৭৪.২% মহিলা বাড়ির অনুমতি পেলেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে পারছেন। (IHDS এই পরিসংখ্যানের জন্য ভারতের ৩৪ টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের শহর থেকে গ্রামের ১৫ থেকে ৮১বছরের ৩৪০০০ মহিলাকে নিয়ে সমীক্ষার কাজটি করেছেন।)

independence day and indian women 2

আজকাল শিক্ষিত পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া, চাকরির সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেড়েছে, মেয়েদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ পরিবারে মেয়েদের সামগ্রিক পরিস্থিতির তেমন উন্নতি ঘটেনি। অন্য এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে অপর একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, ভারতের শ্রমজীবী মহিলার সংখ্যা খুবই নগণ্য, মোট সংখ্যার মাত্র ২৭%। দক্ষিণ এশিয়ায় যে সমস্ত দেশে কমসংখ্যক মহিলা শ্রমজীবী রূপে কাজের সুযোগ ও স্বাধীনতা পান, তাদের সংখ্যার অনুপাতে ভারতের স্থান দ্বিতীয়,  পাকিস্তানের ঠিক পরেই(IndiaSpend, April 2016)। শ্রম প্রদানমূলক কাজ করতে যেতে না দেওয়ার অর্থ মহিলাদের জন্য ইতিবাচক মনে হলেও, বাস্তবে তা নয়। বহু সমীক্ষা ও গবেষণায় উঠে এসেছে ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে দেহব্যবসার কাজে ৭০% মহিলাকে জোর করে নিযুক্ত করা হয় তার মধ্যে ২০% নাবালিকা।( http://www.pucl.org/from-archives/Child/prostitution.htm )
ভারতে গৃহস্থের রান্নাঘরে গৃহিণীর আধিপত্য ৯২.৮৯%, এটা মঙ্গলজনক না পিতৃতন্ত্রের চাল তা বিতর্কিত। এতেও আবার প্রায় ৫০% গৃহস্থ পুরুষ বাড়িতে কি কি রান্না হবে তা ঠিক করতে গৃহিণীকে সাহায্য করেন। (Lavanya Garg, Indiaspend,13 Feb,2017) এটা আপেক্ষিকভাবে সুখের বলে মনে হলেও, বাড়ির মহিলার ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়।
মুখে অনেকে বড় কথা বললেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার পুরুষরা যতটা না পুরুষতান্ত্রিক হন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার ও পরিবারের বয়স জ্যেষ্ঠ মহিলারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম ধারক-বাহক হয়ে ওঠেন।  যে পাত্র যত পণ নিয়ে বিয়ে করেন তার পরিবারের সামাজিক মর্যাদা তত বেড়ে যায় আজকের সমাজেও। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে আমরা যখন ভীষণভাবে নেট(Internet) নির্ভর, তখন প্রযুক্তিও সাহায্য করছে বিবাহযোগ্য পাত্রের রোজগার ও বয়স অনুযায়ী পণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে (Dowry Calculator)। পণপ্রথা ভারতে মেয়েদের অবস্থাকে শোচনীয় করেছে, ভ্রূণ হত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
একবিংশ শতকে,এই স্বাধীনতা দিবস উৎযাপনকে কৃত্রিমতায় আচ্ছন্ন না করে মেয়েদের ধর্ম, সংস্কার, চেতনার ক্লীবত্ব থেকে মুক্তি দিতে দেশের সকল মানুষের অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া উচিত । এই ক্লীবত্ব থেকে উত্তরণ ঘটলেই পুরুষতন্ত্রের অসার চোখ রাঙানী নিষ্প্রয়োজন হবে, মেয়েরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পাবে।
লেখক- ইতিহাসের অধ্যাপক ও গবেষক।