ব্রিটিশরা যখন পরাধীন ভারতে ফুটবল নিয়ে আসে, তখন এই খেলাটিকে সবার আগে রপ্ত করে নিয়ে আঁকড়ে ধরে বাঙালীরা। ব্রিটিশ শাসকদের চিন্তায় ছিল, ফুটবল নামক নেশায় বাঙালীদের বুঁদ করে রেখে স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তিমিত করে রাখা, যে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। এই খেলাটিকে কেন্দ্র করেই উত্তাল হয়ে যায় বাঙালীর আবেগ, বাঙালীর উচ্ছ্বাস, বাঙালীর ভালবাসা। বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে ফুটবল। বাঙালীর মানসিকতায় দারুণ প্রভাব ফেলে সহজ, রোমাঞ্চকর এই খেলাটি। এই কারণেই সেই ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশের ‘ফুটবলের রাজধানী’ হিসেবে বিবেচিত হত কলকাতা। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাঙালীদের কাছে ফুটবল হয়ে ওঠে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র। পরাধীন দেশে প্রতি পদে পদে অপমানে গুমরে মরছিল বাঙালী। এই রকম একটা সময়ে খেলার মাঠে ব্রিটিশদের সঙ্গে সমানতালে লড়াই দেবার একটা সুযোগ এসে যায় বাঙালীর সামনে। মাঠের ফুটবলে ব্রিটিশদের যখন দেশীয় ফুটবলাররা নাজেহাল করে দিতেন, তা দেখে খুব আনন্দ পেত বাঙালীরা। আর বাঙালীদের দল জিতলে সেদিন সেলিব্রেট করত কলকাতা। কিছুক্ষণের জন্য হলেও পাওয়া যেত পরাধীনতার গ্লানি থেকে ‘মুক্তি’র আনন্দ।
এই প্রেক্ষিতেই ১৮৮০-এর দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এই সময় ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিদ্রোহ ভারতীয়দের কল্পনাশক্তিকে জাগরিত করে তুলেছিল। এই আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্য উত্তর কলকাতার মোহনবাগান অঞ্চলের মিত্র ও সেন পরিবারের সাহায্যে ভূপেন্দ্রনাথ বসু ১৮৮৯ সালের ১৫ অগস্ট ‘মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে যে মোহনবাগান ভিলায় ইডেন হিন্দু হোস্টেলের বিরুদ্ধে এই দল প্রথম খেলেছিল।প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঠিক আগে অধ্যাপক এফ. জে. রো জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, এই দল কোনও রাইফেল শ্যুটিং বা আংলিং বা এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত কিনা। মোহনবাগান এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত নয় জেনে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের নাম পাল্টে ‘মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব’ রাখতে। ক্লাবের কর্মকর্তারা এই পরামর্শ মেনে নিয়ে ক্লাবের নাম পরিবর্তন করেন।১৮৯১ সালে কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে এই দল চলে আসে। পরে এই দল উঠে যায় শ্যাম স্কোয়ার অঞ্চলে।
১৮৯৩ সালে মোহনবাগান কোচবিহার কাপে অংশগ্রহণ করে। এটিই ছিল ক্লাবের প্রথম টুর্নামেন্ট।পরবর্তীকালে মোহনবাগান কোচবিহার কাপ ও ট্রেডস কাপ সহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু জয়লাভে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে কলকাতা পৌরসংস্থা শ্যাম স্কোয়ার নামে একটি সরকারি স্কোয়ার উদ্বোধন করলে, এরিয়ান ও বাগবাজার ক্লাবের সঙ্গে মোহনবাগান এই স্কোয়ারে জায়গা পায়। ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত শ্যাম স্কোয়ার ছিল মোহনবাগানের তৃতীয় মাঠ।
১৯০৪ সালে কোচবিহার কাপে অংশ নিয়ে মোহনবাগান প্রথম ট্রফি জেতে। হেয়ার স্পোর্টিং ক্লাবের বিরুদ্ধে ১৫ই আগস্ট প্রথম দিনের ফাইনাল ০-০ ড্র হয়। কিন্তু রেফারির সঙ্গে অসঙ্গত আচরণের জন্য হেয়ার স্পোর্টিং ক্লাবকে আইএফএ এই টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কার করে। তাই মোহনবাগান জয়ী ঘোষিত হয়।১৯০৫ সালে তারা আবার এই ট্রফি জিতেছিল। ২রা আগস্ট মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিরুদ্ধে প্রথম দিনের ফাইনাল ১-১ ড্র হয়।৫ই আগস্ট পুনরনুষ্ঠিত ফাইনালে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে ১-০ গোলে হারিয়ে পরপর ২ বার কোচবিহার কাপ জিতে নেয় মোহনবাগান।এরপরে ১৯০৭, ১৯১২, ১৯১৬, ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৫, ১৯২৮, ১৯৩১, ১৯৩৫, ১৯৩৬, ১৯৪১, ১৯৪৪, ১৯৪৮, ১৯৪৯, ১৯৬২ এবং ১৯৭২ সালেও এই কাপ জিতে মোট ১৮ বার চ্যাম্পিয়ন হয় মোহনবাগান।
এই ১৯০৫ সালেই চুঁচুড়ায় আয়োজিত গ্ল্যাডস্টোন কাপের ফাইনালে মোহনবাগান তৎকালীন আইএফএ শিল্ড জয়ী ডালহৌসিকে ৫-০ গোলে পরাজিত করে তাদের ৩য় ট্রফি জেতে।১৯০৬ সালেও গ্ল্যাডস্টোন কাপ জিতে নেয় মোহনবাগানই।এর পরে ১৯০৮ এবং ১৯১১ সালেও গ্ল্যাডস্টোন কাপ জিতে নিয়েছিল মোহনবাগানই।সবসমেত ৪ বার।
এই ১৯০৬ সালে মোহনবাগান ট্রেডস কাপ ও গ্ল্যাডস্টোন কাপ এক সঙ্গে জয় করে। ১৯০৭ সালে মোহনবাগান আবার ট্রেডস কাপ জেতে। ১৯০৮ সালেও এই কাপ জিতে পরপর তিন বছর এই কাপ জয়ের রেকর্ড সৃষ্টি করে মোহনবাগান। ১৯০৬ আর ১৯০৮, দু’বারই ফ্রি স্কুলকে ফাইনালে হারিয়েছিল মোহনবাগান, ২ বারই ১-০ গোলের ব্যবধানে। তারপরেও আরও ৮ বার (১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৩, ১৯৪৪, ১৯৪৫, ১৯৪৯, ১৯৫০ এবং ১৯৬৫ সালে), মোট ১১ বার ট্রেডস কাপ জেতে মোহনবাগান।
এছাড়া মোট ৬ বার (১৯০৯, ১৯১০, ১৯২৮, ১৯৩৭, ১৯৩৯, ১৯৪০ এবং ১৯৪১) মোহনবাগানের লক্ষ্ণীবিলাস কাপ জেতারও শুরু হয়েছিল এই সময়েই।১৯০৯ সালে ফাইনালে তারা জেতে গর্ডন হাইল্যান্ডার্সকে ৬ দিন লড়াইয়ের পরে ১-০ গোলে হারিয়ে।কিন্তু এই গর্ডন হাইল্যান্ডার্সের কাছেই ১৯০৯য়ের আইএফএ শিল্ডের ২য় রাউন্ডে হেরে যায় মোহনবাগান।
আইএফএ শিল্ডে মোহনবাগানের খেলার পিছনেও ছিল একটা ইচ্ছেপূরণের স্বপ্ন। ডালহৌসি বা ক্যালকাটার মতো টিমকে হারানো, গ্ল্যাডস্টোন কাপ-লক্ষ্ণীবিলাস কাপ-ট্রেডস কাপ জেতার মতো সাফল্য পাওয়া গেলেও তখনকার ক্লাব সম্পাদক শৈলেন বসুর পাখীর চোখ ছিল আইএফএ শিল্ডের দিকে। এখানে সাফল্য পেলে তখন মোহনবাগানকে যারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করত, সেই শোভাবাজার, কুমারটুলি বা টাউন ক্লাবের মুখ বন্ধ করে দেওয়া যাবে। অনেক চেষ্টার ফলস্বরূপ এই ১৯০৯ সাল থেকেই আইএফএ শিল্ডে খেলার অনুমতি পেয়েছিল মোহনবাগান।পরের বছর ১৯১০ সালে আইএফএ শিল্ডে মোহনবাগান বিদায় নেয় ১ম রাউন্ডে ইস্টার্ণ বেঙ্গল রেলওয়েজের কাছে হেরে গিয়ে।
১৯১১ সালে কিন্তু অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কোমর বেঁধে মাঠে নামে মোহনবাগান, আইএফএ শিল্ড জিততে। অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি নিজে দলগঠনে উদ্যোগ নিলেন। অবশেষে ২-৩-৫ সিস্টেমে গঠিত মোহনবাগান দল দাঁড়ালো এই রকম-
গোলরক্ষক হীরালাল মুখার্জী। রাইট ব্যাক ভূতি সুকুল। লেফট ব্যাক সুধীর চ্যাটার্জী। রাইট হাফ মনমোহন মুখার্জী। সেন্টার হাফ রাজেন সেনগুপ্ত।লেফট হাফ নীলমাধব ভট্টাচার্য। রাইট আউট কানু রায়। রাইট ইন হাবুল সরকার।সেন্টার ফরোয়ার্ড অভিলাষ ঘোষ। লেফট ইন বিজয়দাস ভাদুড়ি। লেফট আউট শিবদাস ভাদুড়ি (অধিনায়ক)। এদের মধ্যে শুধু লেফট ব্যাক সুধীর চ্যাটার্জী বুট পরে খেলতেন, বাকি সবাই খালি পায়ে। তখন সব খেলাই ছিল ৫০ মিনিটের, উভয়ার্ধে ২৫ মিনিট করে।
সোমবার ১০ই জুলাই ১৯১১ তারিখে মোহনবাগানের শিল্ড অভিযান শুরু হয়। ১ম রাউন্ডে মূলত ইউরোপিয়ান ছাত্রদের নিয়ে গড়া সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজকে মোহনবাগান উড়িয়ে দেয় ৩-০ গোলে। ১ম গোল অভিলাষ ঘোষ করার পরে ২টি গোল করেন বিজয়দাস ভাদুড়ি।
২য় রাউন্ডে রেঞ্জার্সের মুখোমুখি হয় মোহনবাগান, কাস্টমস মাঠে, শুক্রবার ১০ই জুলাই ১৯১১ তারিখে। বৃষ্টিভেজা মাঠে রেঞ্জার্সের গাজোয়ারি ফুটবলের বিরুদ্ধে প্রথমার্ধেই অধিনায়ক ও লেফট আউট শিবদাস ভাদুড়ির করা ২ গোলে এগিয়ে যায় মোহনবাগান। দ্বিতীয়ার্ধে ১টি গোল শোধ দেন রেঞ্জার্সের অ্যালেন।তার আগে গোলরক্ষক হীরালাল মুখার্জী অ্যালেনের পেনাল্টি শট বাঁচিয়ে দেওয়ায় ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে পরের রাউন্ডে চলে যায় মোহনবাগান।
৩য় রাউন্ডে বুধবার ১৯শে জুলাই ১৯১১ রাইফেল ব্রিগেডের মুখোমুখি হয় মোহনবাগান, ডালহৌসি মাঠে। প্রায় তুল্যমূল্য তীব্র গতিময় ম্যাচে বিজয়দাস ভাদুড়ির করা একমাত্র গোলে জিতে যায় মোহনবাগান এবং সেমিফাইনালে ওঠে।
সেমিফাইনালে মোহনবাগানের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তখনকার দুর্ধর্ষ মিলিটারি দল ফার্স্ট মিডলসেক্স, ডালহৌসি মাঠে, সোমবার ২৪শে জুলাই ১৯১১ তারিখে। সকাল থেকে মাঠে দর্শকরা আসতে থাকেন।খেলা শুরুর অনেক আগেই মাঠে তিলধারণের জায়গা ছিল না। অত্যুৎসাহীরা “পজিশন নেন” গাছের উপরে। সিংহভাগ দর্শক চাইছিলেন মোহনবাগানের জয়। কিছুটা আধিপত্য নিয়ে খেলে প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়ে যায় ফার্স্ট মিডলসেক্স। ফরোয়ার্ড লাইনে পজিশন অদলবদল করে মোহনবাগান তাদের চমকে দেয় ২য় অর্ধে।এবং খেলা ১-১ হয়ে যায় কানু রায়ের গোলে। ১-১ গোলে অমীমাংসিত থেকে যায় সেদিনের খেলা। একদিন বাদ দিয়ে বুধবার ২৬শে জুলাই ১৯১১ সেই ডালহৌসি মাঠে রিপ্লে সেমিফাইনাল চলাকালীন মাঠের পূর্বদিকের গোললাইনের দর্শকদের ভিড়ের চাপে গোলপোস্ট ভেঙ্গে যায়। কিছুক্ষণ বন্ধ থাকার পরে আবার খেলা শুরু হয়। ১ম অর্ধের খেলা গোলশূন্য থাকার পরে দ্বিতীয়ার্ধের শেষদিকে ৩টি গোল করে ৩-০ গোলে জিতে ফাইনালে উঠে যায় মোহনবাগান।গোল করেন শিবদাস ভাদুড়ি, হাবুল সরকার এবং কানু রায়।
ফাইনালের দিন ঠিক হয় শনিবার ২৯শে জুলাই, ১৯১১। স্থান ক্যালকাটা এফ সি মাঠ (এখন মোহনবাগান মাঠ)। প্রতিদ্বন্দ্বী ফৈজাবাদের ব্রিটিশ আর্মির একটি দল ইস্ট ইয়র্ক রেজিমেন্ট।খেলার মাঠে যেন “স্বাধীনতার লড়াই”-র প্রতিনিধি সেদিনের মোহনবাগান।কলকাতা সেদিন পরিণত হয় ফুটবল নগরীতে। কলকাতার বাইরের বাঙলা এবং প্রতিবেশী রাজ্য থেকেও বহু লোক সেদিন খেলা দেখতে আসেন। ক্লাব সম্পাদক শৈলেন বসু সকালে পুরো দলকে কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে পুজোশেষে প্রসাদী ফুল তুলে দেন সবার হাতে এবং কপালে পরিয়ে দেন রক্তচন্দনের তিলক, যার মধ্যে ছিলেন খ্রিস্টান সুধীর চ্যাটার্জীও।খেলা শুরুর ৬ ঘন্টা আগেই মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়।বিকেল ৫.৩৫ মিনিটে খেলা শুরু হয়।মোহনবাগান টসে হেরে ইডেনের দিকের গোলরক্ষা করে ১ম অর্ধে। একতরফা না হলেও প্রভূত প্রাধান্য নিয়েও ১ম অর্ধে গোল করতে ব্যর্থ হয় মোহনবাগান। প্রায় নিরুপদ্রবেই প্রথমার্ধ কাটান গোলকিপার হীরালাল মুখার্জী।অভিলাষ ঘোষ আর নীলমাধব ভট্টাচার্য সহজ সুযোগ নষ্ট করেন। বিরতির পরে তেড়েফুঁড়ে শুরু করে ইস্ট ইয়র্ক এবং ২য় অর্ধের ১৪ মিনিটে পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি কিকে জ্যাকসন গোল করে তাদের এগিয়ে দেন। গোলকিপার হীরালাল মুখার্জী সবাইকে তার সামনে থেকে সরে যেতে বললেও গোললাইনের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাইট ব্যাক ভূতি সুকুল এবং তারই গায়ে লেগে জ্যাকসনের শট গোলে ঢুকে যায়।মোহনবাগান গোলশোধের মরিয়া চেষ্টা করার ফাঁকে প্রতিআক্রমণে ৩টি কর্ণার পায় ইস্ট ইয়র্ক। খেলার প্রায় শেষদিকে, ৫ মিনিট বাকি থাকতে কানু রায়ের পাস থেকে বল পেয়ে ইস্ট ইয়র্কের দু’জন রক্ষণের খেলোয়াড়কে অতিক্রম করে জোরালো শটে গোল করেন অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি।গোল খেয়ে বিভ্রান্ত ইস্ট ইয়র্ক খেলোয়াড়রা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তিন মিনিট বাদে, আবার গোল দেয় মোহনবাগান।কয়েকজনকে কাটিয়ে শিবদাস ভাদুড়ি পাস বাড়ান অভিলাষ ঘোষকে। চলন্ত বলে অভিলাষ ঘোষের শট ইস্ট ইয়র্কের গোলরক্ষককে পরাস্ত করে জালে জড়িয়ে যায়।ম্যাচের ভাগ্য ওখানেই নির্ধারিত হয়ে যায়।আনন্দে আত্মহারা দর্শকদের গগনভেদী চিৎকার চারদিক কাঁপিয়ে তোলে।চটি, জুতো, ছাতা, যা যা হাতের নাগালে ছিল, সব আকাশে উড়তে থাকে। সবুজ মেরুণ পতাকা আর ঘুড়িতে ঢেকে যায় চারদিক। আর ম্যাচে ফেরার সময় ছিল না ইস্ট ইয়র্কের জন্য। ২ মিনিট পরেই রেফারীর লম্বা বাঁশীতে খেলা শেষ। ২-১ গোলে ম্যাচ জেতে মোহনবাগান। পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া সূর্য সাক্ষী রয়ে গেল ভারতের ফুটবল আকাশে নতুন সূর্যোদয়ের।
প্রথম ভারতীয় ফুটবল দল হিসেবে মোহনবাগান খেলার মাঠে ব্রিটিশদের বাধ্য করল নতজানু হতে। মোহনবাগান তখন ভারতের এমনকি কলকাতারও সব থেকে পুরনো ক্লাব ছিল না। কিন্তু সাহসিকতা ও পরিচ্ছন্ন খেলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেশের প্রধান ক্লাবের মর্যাদায় মোহনবাগান উঠে এল ২৯শে জুলাই ১৯১১ তারিখে। সেই সময় ভারতে বিদেশী দলগুলোর, বিশেষত সামরিক দলগুলোরই বেশী প্রাধান্য ছিল।মোহনবাগান ক্লাব সেই সব শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে লড়ে শেষ পর্যন্ত ইস্ট ইয়র্কশায়ার রাইফেলস কে পরাজিত করে আই এফ এ শিল্ড জিতে নেয়।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে শিল্ড হাতে নিয়ে অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি বলে ওঠেন “থ্রি চিয়ার্স ফর ইস্ট ইয়র্ক।” “হিপ হিপ হুররে” বলে বাকিরা গলা মেলান।এটাই ছিল টিম মোহনবাগানের যথার্থ খেলোয়াড়ী মনোভাব। শিল্ড নিয়ে কাস্টমস মাঠের উপর দিয়ে নিজেদের তাঁবুতে ফেরার সময়ে গালে সাদা দাড়ি, পরণে সাদা ধুতি সাদা চাদর এক বৃদ্ধ কেল্লার উপর উড়তে থাকা ইউনিয়ন জ্যাক দেখিয়ে সুধীর চ্যাটার্জীকে বলেন “আজ তো হল। ওটা কবে হবে?” পাশ থেকে কেউ বলেন “যেদিন মোহনবাগান আবার শিল্ড জিতবে, সেদিন ওটাও হবে।” কাকতালীয় হলেও সত্যি এটাই যে মোহনবাগান এরপরে আবার শিল্ড জিতেছিল ১৯৪৭ সালে।সেই ১৯৪৭, যে বছর ইউনিয়ন জ্যাক ভারত থেকে চিরবিদায় নেয়। ক্লাব তাঁবু থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে মিছিল গিয়েছিল শ্যামবাজারে ক্লাব সম্পাদক শৈলেন বসুর বাড়ির দিকে।সঙ্গী ছিল হাজার হাজার জনতা। মোহনবাগানের জয়ধ্বনিতে কলকাতার রাজপথ ছিল মুখরিত।শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে ১৯১১র ১১ বীর যোদ্ধাকে বরণ করা হয়। অন্ধকারে ডুবে থাকা সাহেবপাড়া চৌরঙ্গীর বিপরীতে আলো ঝলমল শ্যামবাজার ছিল মরিচীকার মতোন। শৈলেন বসুর বাড়িতে বিরাট ভোজসভা আয়োজিত হয় সেদিন এবং তারপর অভিনীত হয় যাত্রাপালা “ভীষ্ম বিজয়”।
বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী সংবাদপত্রে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয় উপলক্ষে প্রশংসার বন্যা বয়ে যায়।ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধে অনুঘটকের কাজ করেছিল বুট পরা গোরা মিলিটারি দলের বিরুদ্ধে খালি পায়ের ফুটবলসৈনিকদের এই অলৌকিক লড়াই ও জয়।
কবি করুণানিধন বন্দ্যোপাধ্যায় এই জয় উপলক্ষে একটি জনপ্রিয় গান রচনা করেছিলেন। গানটি “মানসী” পত্রিকার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই গানটির প্রথম কয়েক লাইন ছিল এই রকম:
জেগেছে আজ দেশের ছেলে পথে লোকের ভিড়,
অন্তঃপুরে ফুটল হাসি বঙ্গরূপসীর।
গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত,
আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।
আজকের এই বিজয়বাণী ভুলবে নাকো দেশ,
সাবাশ সাবাশ মোহনবাগান! খেলেছ ভাই বেশ!
এই জয়ের শতবর্ষ উদযাপন করেছিল মোহনবাগান ক্লাব, ২০১০-১১ সালে, নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।“এগারো” নামের একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র ছিল যার অঙ্গ।১৯১১র আইএফএ শিল্ড জয়ের ইতিহাস চিত্রিত আছে ঐ চলচ্চিত্রে।
১৯১১র আইএফএ শিল্ড জয়ের স্মরণে এর ৯০ বছর পর, ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর এই ২৯শে জুলাই দিনটি “মোহনবাগান দিবস” হিসেবে উদযাপন করে আসছে মোহনবাগান ক্লাব। মোহনবাগানের হয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য প্রতি বছর এক বা একাধিক প্রাক্তন ক্রীড়াবিদকে “মোহনবাগান রত্ন” উপাধিতে ভূষিত করা হয় এই দিনে। এছাড়াও বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদকে সম্মানজ্ঞাপন, বিশিষ্ট খেলোয়াড় ও নাগরিকদের আজীবন সদস্যপদ প্রদান, প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ ইত্যাদি নানা আয়োজনে মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল মোহনবাগান ক্লাব প্রাঙ্গণ ঐদিন, গত ১৯ বছর ধরে। ২০০১ থেকে ২০১৯ অবধি টানা ১৯ বছর মোহনবাগান মাঠেই মোহনবাগান দিবস পালিত হয়েছিল।

২০০১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত “মোহনবাগান রত্ন” সম্মান প্রাপকদের তালিকাটি (সকলেই ফুটবলার বা কর্মকর্তা বা ফুটবলার-কর্মকর্তা) এই রকম-
২০০১ শৈলেন মান্না
২০০২ ড: টি. আও (মরণোত্তর)
২০০৩ শিবদাস ভাদুড়ি (মরণোত্তর)
২০০৪ গোষ্ঠ পাল (মরণোত্তর)
২০০৫ চুনী গোস্বামী
২০০৬ উমাপতি কুমার (মরণোত্তর)
২০০৭ ধীরেন দে (মরণোত্তর)
২০০৮ মহম্মদ আবদুস সাত্তার
২০০৯ সমর ব্যানার্জী
২০১০ হীরালাল মুখার্জী, ভূতি সুকুল, সুধীর চ্যাটার্জী, মনমোহন
মুখার্জী, রাজেন সেনগুপ্ত, নীলমাধব ভট্টাচার্য, কানু রায়, হাবুল
সরকার, অভিলাষ ঘোষ, বিজয়দাস ভাদুড়ি (সকলেই
মরণোত্তর)
২০১১ প্রদীপ কুমার ব্যানার্জী
২০১২ জার্ণাইল সিং (মরণোত্তর)
২০১৩ বলাইদাস চ্যাটার্জী (মরণোত্তর)
২০১৪ অরুময়নৈগম
২০১৫ করুণাশঙ্কর ভট্টাচার্য (মরণোত্তর)
২০১৬ সৈয়দ নইমুদ্দিন
২০১৭ সুব্রত ভট্টাচার্য
২০১৮ প্রদীপ চৌধুরী
২০১৯ কেশব দত্ত, প্রসূন ব্যানার্জী
২০২০ গুরবক্স সিং, পলাশ নন্দী
২০২১ শিবাজী ব্যানার্জী (মরণোত্তর)
২০০১ থেকে ২০১৯ অবধি টানা ১৯ বছর মোহনবাগান মাঠেই মোহনবাগান দিবস পালিত হয়েছিল। কিন্তু করোনার সর্বগ্রাসী তান্ডবের কারণে ১০৯ বছর আগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্মরণে এই ২০২০তে, উদযাপিত হয়েছিল “ভার্চুয়াল” ফর্মে। ২০২০ সালে “মোহনবাগান রত্ন” খেতাব পেয়েছিলেন হকি অলিম্পিয়ান গুরবক্স সিং এবং ক্রিকেটার পলাশ নন্দী। নাসডাকের বিলবোর্ডেও ২০২০তে জায়গা করে নিয়েছিল মোহনবাগান, হাওড়া ব্রিজ সেজেছিল সবুজ মেরুণ রঙে জারিত হয়ে। ২০২১য়েও এই অনুষ্ঠান উদযাপন হবার কথা যাবতীয় কোভিড বিধি মেনেই।
১৩২ বছরের লম্বা প্রাণচঞ্চল ঐতিহাসিক পথ হেঁটে আসা মোহনবাগান অধুনা কর্পোরেট ছোঁয়ায় আরও বহুদিন বয়ে নিয়ে যাবে কলকাতা ফুটবলের মশাল, কলকাতা ফুটবলের আজকের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এই কামনা আজ প্রতিটি মোহনবাগানপ্রেমী তথা ফুটবলপ্রেমীর।