প্রতিদিন ভোর হয় কলকাতায়। কিন্তু কোনও ভোরই পঁচিশে বৈশাখের ভোরের মতো নয়। অন্তত তাই ছিল ২০১১ সন অবধি। সত্তর, আশি, নব্বইয়ের দশকগুলিতে, এমনকি তারপরেও আমরা সবাই, বাঙালিরা, মেতে উঠতাম সেই ভোরের উৎসবের এক অমোঘ আকর্ষণে, রবি ঠাকুরের গানে। শ্রেণীহীন বাঙালি, সম্প্রদায়হীন বাঙালি, এক দেহে হল লীন, পঁচিশে বৈশাখের ভোরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি আর রবীন্দ্রসদনে। উত্তর কলকাতার মানুষদের কাছে ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি আর দক্ষিণ কলকাতার মানুষদের কাছে ছিল রবীন্দ্রসদন। যদিও আক্ষরিক অর্থে এরকম কোনও বিভাজন রেখা ছিল না। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, সব জায়গার মানুষই ওই দু’জায়গায়। এমন অনেকে আছেন যাঁরা রবীন্দ্রসদনে কিছুক্ষণ থেকে চলে যেতেন জোড়াসাঁকো। আবার জোড়াসাঁকো থেকেও অনেকে চলে আসতেন রবীন্দ্রসদন। শিল্পীদের ক্ষেত্রেও তাই। যিনি রবীন্দ্রসদনে গান গাওয়া শেষ করলেন তিনি এবার জোড়াসাঁকো গিয়ে গান গাইবেন। একইভাবে জোড়াসাঁকো থেকে গান গাওয়া শেষ করে রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে চলে আসতেন শিল্পীগণ। কলকাতার দু’প্রান্তে দুটো আলাদা অনুষ্ঠান হলেও পারস্পরিক যোগসূত্রতায় তা আলাদা ছিল না কখনই। তাছাড়া শুধু কলকাতা তো নয়, মানুষ আসতেন কলকাতার বাইরে শহরতলী থেকে, দূর-দূরান্ত থেকে। প্রায় কাকভোরে রবীন্দ্র সদনে পৌঁছে দেখতাম , অত ভোরেই কত লোক পৌঁছে গিয়েছেন।

আমি বরাবরই রবীন্দ্র সদনে গিয়েছি। রবীন্দ্র সদনের পরিবেশের আকর্ষণ ছিল যেন জোড়াসাঁকোর থেকে বেশী। আমার কাছে। আর তাছাড়া আমরা যারা ওই সময়, মানে আশির দশকে লিটলম্যাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তারা অধিকাংশই  চলে আসতাম  রবীন্দ্র সদনে। ওইদিনটি রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণ হয়ে উঠত এক স্বতঃস্ফূর্ত  লিটল ম্যাগাজিন মেলা। গান, আড্ডা, সাহিত্য পত্রিকার সমারোহ, প্রিয় মানুষদের সঙ্গে মিলন, বাঙালির প্রাণের স্পন্দনের ঢেউ উঠত ভোরের ওই উৎসবে। এই পরম্পরা অব্যাহত ছিল ২০১১ অবধি।

আমি রাজনীতি বুঝি না, দল বুঝি না, বুঝি শুধু মানুষ, মানুষের জীবন, জীবনের ভোর দেখার জন্য বড়ই কাঙাল। দুপুর অনেক দেখেছি, দুপুরের প্রখর উত্তাপে ক্লান্ত, অসুস্থ। আমার তাই কাতর প্রার্থনা- হে প্রশাসক, আমাদের জীবনের সেই স্নিগ্ধ ভোর এনে দাও, ফিরিয়ে দাও সেই পঁচিশে বৈশাখের রবীন্দ্র জয়ন্তীর ভোর, রবীন্দ্র সদনে। আমরা আবার ছুটে যাই সেই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে, মেতে উঠি রবি ঠাকুরের গানে, কবিতায় , লিটল ম্যাগাজিনে , ভোরের উন্মুক্ত উৎসবে।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্র জন্মোৎসবের প্রচলন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই প্রচলন করে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অবর্তমানে সেই প্রথা আরও জোরালো হয়ে ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্র সদনের ভোরের অনুষ্ঠানের শুরু অনেক পরে, ষাটের দশকের শেষে, সম্ভবত ৬৮/৬৯ সন থেকে কারণ ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর সময়ে রবীন্দ্র সদনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ঐ বছর ৫ই মে’ তারিখে। নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল ১৯৬৭ সনের অক্টোবর মাসে। তাই মনে হয়, পরবর্তী ৬৮/৬৯ সন থেকেই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্র সদনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পঁচিশে বৈশাখের ভোরের অনুষ্ঠান। বা তারও পরে। যবে থেকেই শুরু হোক না কেন, পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্র সদনের ভোরের ঐ অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছিল বঙ্গ জীবনের অঙ্গ, আমাদের অহংকার ও আনন্দ। কিন্তু ভোরের সেই ঐতিহ্য, সেই আনন্দ আর অব্যাহত রইল না। ভোরের শিশিরের মতোই মিলিয়ে গেল ২০১২ সন থেকে, যখন থেকে ভোরের উৎসবকে অপরাহ্নে সময়ান্তরিত করা হল। কিন্তু ভোর বা সকালের যে স্নিগ্ধ আনন্দ তা কি অপরাহ্নের প্রখর  তাপের সময়ে পাওয়া যায়? ফলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি আর রবীন্দ্র সদন মিলে রবীন্দ্র জয়ন্তীর যে এক পূর্ণ উৎসবময় আনন্দ, তা খণ্ডিত হল। খণ্ডিত দেহ যেমন পূর্ণ দেহের মতো প্রাণোচ্ছল থাকতে পারে না, এক্ষেত্রেও তাই হল। এতদিনের ঐতিহ্যের প্রাণোচ্ছল আমেজটাই নষ্ট হয়ে গেল, হারিয়ে গেল।  গত ছয় বছর যাবৎ সেটাই ঘটছে।

Rabindra Sadan
-ফাইল চিত্র।

এখন পঁচিশে বৈশাখের ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে রবীন্দ্র সদনের সেই ভোরের উৎসবের বিগত দিনগুলির স্মৃতি মনে পড়ে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। মনে পড়ে সকালের আলো আর রবি ঠাকুরের গান মাখামাখি হয়ে বাঙালির আনন্দময় উজ্জ্বল মুখগুলি। আর ভাবি , আমাদের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বাঙালিদের কোনওকিছুতেই আর আত্মদহন হয় না। আত্মঘাতী হীনমন্যতার অসুখে ভুগে ভুগে আমাদের জীবনের তেজময়তা এতটাই স্তিমিত হয়ে গেছে যা প্রায় মৃতদেহের প্রতিবাদহীন নীরবতার সমার্থক। প্রতিদিনই নানা রকম তাৎক্ষণিক হুজুগে প্রতিবাদের খেলায় মেতে উঠে দুদিন পরেই তা ভুলে যাই। কিন্তু যখন ঐতিহ্যের লুণ্ঠন হয়, এর জন্য আমাদের কোনও আত্মগ্লানি নেই, আমরা ভীত, আমরা নিরাপদ স্বার্থ চেতনা দ্বারা অপহৃত।

কে জানে, এইসব ভাবনা হয়ত আমার অতি আবেগময়তার ফসল। আমিই ভুল। আর চতুর্দিকে হিম নীরবতাগুলি ধ্রুব সত্য।

আমি রাজনীতি বুঝি না, দল বুঝি না, বুঝি শুধু মানুষ, মানুষের জীবন, জীবনের ভোর দেখার জন্য বড়ই কাঙাল। দুপুর অনেক দেখেছি, দুপুরের প্রখর উত্তাপে ক্লান্ত, অসুস্থ। আমার তাই কাতর প্রার্থনা- হে প্রশাসক, আমাদের জীবনের সেই স্নিগ্ধ ভোর এনে দাও, ফিরিয়ে দাও সেই পঁচিশে বৈশাখের রবীন্দ্র জয়ন্তীর ভোর, রবীন্দ্র সদনে। আমরা আবার ছুটে যাই সেই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে, মেতে উঠি রবি ঠাকুরের গানে, কবিতায় , লিটল ম্যাগাজিনে , ভোরের উন্মুক্ত উৎসবে।