বাঘিনী ও বাইসনের এক টাকার(চৌবাচ্চা) দুধারে বসে জলপানের ছবিটা স্যাঞ্চুয়ারী পত্রিকায় দেখে লোভ সামলাতে না পেরে ২০০১ সালে গিয়েছিলাম ‘নাগজিরা’ ন্যাশনাল পার্ক। অবশ্য ঐ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আশায় মরে চাষা। ঐ আশায় চেষ্টা করেও তার পরে আর যাওয়া হয়নি। কোন না কোন বাধা এসে পড়েছে। অবশেষে এলাম হীরকের সাথে। মোট চারজন। সময় মিলিয়ে মুম্বই এক্সপ্রেস(স্পেশাল) নামিয়ে দিল গোন্ডিয়া স্টেশনে। মহেশ বাবুর টাটা সুমো অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। ‘বিষেন’ আমাদের সঙ্গী তবে জঙ্গল ঘোরার অভিজ্ঞতা হবে এই প্রথম।
শহরের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে চা-এর দোকানে কিঞ্চিৎ পোহা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে শুরু হল প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটারের যাত্রা। পথে কোন একঘেয়েমি নেই। কোথাও রাস্তার দুধার দিয়ে হলুদ হেলমেট পড়ে শ্রমিকের দল চলেছে কারখানায়। কোথাও স্কুলের ছেলেমেয়েরা রঙিন সাজে সাইকেল বা পায়ে হেঁটে চলেছে স্কুলে। জঙ্গল শুরু হতে রাস্তার সৌন্দর্যটা বেড়ে গেল। ৯টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ‘চোরখামরা’ গেটে। ‘পিটজোরি’, ‘শাকোলি’ এরকম কয়েকটি এন্ট্রি পয়েন্ট আছে। গাইড নেওয়া এখন বাধ্যতামূলক। ট্যুরিস্টদের পক্ষে যেমন ভাল তেমনি কিছুটা হলেও স্থানীয় অধিবাসীদের কাজের ব্যবস্থা হচ্ছে এর মাধ্যমে। এন্ট্রি ফি জমা দেওয়ার পর অল্পবয়সী গাইড ‘পুরেশ’ আমাদের নিয়ে চলল নাগজিরার অফিসে। জঙ্গলে ঢুকতেই অভ্যর্থনা জানাল বাচ্চা সহ নীলগাই, হরিণ। ৯ কিমি রাস্তা। দুধারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চেনা নাগজিরা অফিসে এসে গেলাম ১০টার আগে। নাগজিরা আছে নাগজিরাতে। শুধু পুরানো মানুষগুলো নেই। মনে হচ্ছিল এই তো সেদিন ঘুরে গেলাম। সংখ্যায় কম হলেও হনুমানের দল এখনও ঘুরে বেড়ায় ক্যান্টিনের কাছে, খাবারের আশায়।
চেক ইন ১২টায়। দশ মিনিটের মধ্যে অফিস ফরম্যালিটিস শেষ। হাতে অনেকটা সময়। ক্যান্টিনে দর্শন দেওয়ার পক্ষে ঠিক সময় এটা নয়।
‘নিলয়’ ও ‘লঘাট’ এর পাশের রাস্তা ধরে চলেছি। নাগজিরার জঙ্গল আগের তুলনায় আরও ঘন ও গভীর হয়েছে। বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরার ফাঁকে পুরেশের কাছে শুনেছি ওর নানা অভিজ্ঞতার কথা। বৃহস্পতিবার ছাড়া প্রতিদিন জঙ্গলে আসতে হয়। বিশেষত সিজ্ন টাইমে। দুদিন আগে দেখেছে দুই বাচ্চাসহ বাঘিনীকে। পরে জেনেছি রাস্তার নাম আন্দারবন রোড। ঐ রোড ধরে যাচ্ছি। হঠাৎ দূরে এক প্রাণীকে রাস্তায় দেখে পুরেশ জানিয়ে দিল সে আর কেউ নয়- বাঘ। রাস্তা দিয়ে গাড়ির দিকে আসছে। কোথা থেকে হাজির হল বন দপ্তরের এক মোটর বাইক আরোহী। কি ভেবে এগিয়ে গেল বাঘের দিকে। ফলে যা হবার তা হল। বাঘ হারিয়ে গেল জঙ্গলে। মনে মনে গালি দিচ্ছি। পুরেশ দেরি না করে বাঘের জঙ্গলে চলে যাওয়ার জায়গা অব্দি গিয়ে ঘুরিয়ে নিল গাড়ির মুখ। খানিকটা এগোতেই চোখে পড়ল হলুদ ডোরাকাটা প্রানীকে জঙ্গলের মধ্যে। কিছুটা পর চলে এল রাস্তায়। বাঘ নয় বাঘিনী। এরপর সবটাই বাঘিনীর জন্য। পিছু পিছু চলার সময়টা প্রায় ৪৫ মিনিট। বাঘিনী বিরক্তি প্রকাশ করেছে মাত্র একবার। রাস্তার ধারে এক টাকায়(চৌবাচ্চা) জল খেতে বাঘিনী নেমে যেতে দাঁড়িয়ে গেলাম একেবারে মুখটায়। পিপাসাটা বোধহয় মেটেনি। কিছুটা পরে উঠেই গাড়ি দেখে বিরক্ত হয়ে দাঁত বের করে মুখ দিয়ে ফ্যাঁশ আওয়াজ করে ভয় দেখিয়ে ছুটে চলে গেল কাছাকাছি অন্য টাকার কাছে। প্রাণ ভরে পিপাসা মিটিয়ে ফিরে এল রাস্তায়। আবার চলা শুরু। সামনের ডান পায়ে একটু চোট আছে- সেজন্য রাস্তা দিয়ে চলেছে। ওর চলা, বসা ও রাস্তায় ঘুমানোয় কোন বিঘ্ন ঘটায়নি আমাদের উপস্থিতি। কাঁচা ঘুম থেকে উঠে আবার কিছুটা হাঁটা। পরে চলে গেল জঙ্গলে। ভাবছি ফিরে আসব। বাধা দিল পুরেশ। অন্য রাস্তায় এসে থামল এক নালার কাছে। বাঘিনী নাকি ঐ নালা দিয়ে আসবে। অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল ওর কথা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চলে এল বাঘিনী। আমাদের উপস্থিতিকে অবজ্ঞা করে নালা দিয়ে চলে গেল অনেক দূরে- দৃষ্টির আড়ালে।
কখন যে ফরেস্টে থাকার নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম আমাদের ‘অস্থায়ী’ ঠিকানা ‘লতাকুঞ্জে’। ট্যুরিস্টরা বের হব বের হব করছে। ধন্যবাদ জানালাম ওনাদের। ভাগ্যিস ঘরটা ছাড়েননি। ‘লতাকুঞ্জে’র অবস্থান নিরিবিলিতে। ডান দিকে ‘মেডিসিনাল প্ল্যান্ট’-এর বাগান। সামনে বিরাট ঝিল। ঝিলের ওপারে ‘নিলয়’ আর ‘লগহাট’। সে সময় লতাকুঞ্জের তিনটে ঘরের মধ্যে দুটো ব্যবহারযোগ্য। বিলাসবহুল না হলেও জঙ্গলে থাকার পক্ষে যথেষ্ট।
লাঞ্চের পর তিনটে নাগাদ আবার জঙ্গলে। কোন প্রবেশমূল্য লাগেনা। সকালে বাঘিনী দেখে সবাই খুশী। নাগজিরায় বন্যপ্রানীর দেখা না মিললেও হতাশ হতে হয়না। বনেরসৌন্দর্যক্যামেরা বন্দী করার জন্য। ফরেস্টের ভিতরে বনের সুরক্ষার জন্য আছে বিভিন্ন ক্যাম্প। হাতিখুদরা রোডের শেষপ্রান্তে ‘চিপরা’ ক্যাম্প। দেখা হল তিনজন বনরক্ষীর সাথে। ওরাঐ বাঘিনীকে ক্যাম্পের সামনে দেখেছে ১২টা নাগাদ। ক্যাম্পের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় বন্যপ্রানীরা। দিনে অসুবিধে না হলেও রাতে ঘর থেকে বের হয়না। ঘরের ভিতরে রান্না, খাওয়া দাওয়া।
বিকেলের ট্রিপে হাতিখুদরা, কাটেথুয়া, শাকোলি, আলোবাব পানভট, ঘাটমারা, বোদলকাসা, থাটিঝেড়ী, কুসুমতন্ডী, সারকুলার, চিতলমার্গ, টাইগার টেল ও লিঙ্ক রোড ঘুরে নীলগাই, সম্বর, চিতল, বাইসনের দেখা পেলেও দেখা হয়নি বুনো কুকুর। প্রতিটি রাস্তার একটা নিজস্বতা আছে। লেন্ডি, সুরিয়া, বিজা, ঘোষ্ট, সাজা, শাল, সেগুন, তেন্দু, ধাওড়া, অমলতাস, মহুয়া, আওলা, অর্জুন, শিমুল, ছাতিম, ঘুঘু’এর বনে ঢাকা নাগজিরা। ভিউ পয়েন্ট থেকে চোখে পরে নাগজিরার অপরূপ রূপকে। বাঁশ গাছের ঝোপ দেখা মেলে প্রায় প্রতি রাস্তায়।
অবশেষে দেখা পেলাম শুধু বাঘিনী নয়- সঙ্গে বাচ্চা। অনেক গাড়ির ভিড় দেখে নিয়মমত দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা পর দেখা মিলল বাঘিনীর। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ির সামনে। ড্রাইভার বিষেণ ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। কিছুটা পরেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল কয়েক মাসের বাচ্চা। তবে গাড়ির কাছে নয়। সব গাড়িকে অতিক্রম করে উঠে এল রাস্তায়। চলল মায়ের পিছু পিছু। আমরাও ফিরে এলাম লতাকুঞ্জে।
সকালের ট্রিপে বাইসন দেখাতে মরিয়া পুরেশ নাগজিরার প্রায় সব রাস্তা ঘুরেও খোঁজ পায়নি কোন বাইসনের। এটাই এইসব বনের বৈশিষ্ট্য। প্রথমবার দেখা পরিবেশের সাথে কোন মিল পাওয়া যায় না। এক জঙ্গলে দুবার বা তিনবার গেলে প্রতিবারই নতুন মনে হবে জঙ্গলকে। বাঘিনীর সম্বর শিকার করার খবরটা পেয়ে একটু আশান্বিত হলেও দেখা পাইনি। সাড়ে দশটা নাগাদ ফিরে এলাম জঙ্গল থেকে। ব্রেকফাস্ট করে চলে যাব গোন্ডিয়া। ১২টার মধ্যে পৌঁছতে হবে চোরখামরা গেটে। বিদায়ের পালাটা আসতেই মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে যায়। চোরখামারা গেটে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় ১২টা। দুটো ছোট বাস দাঁড়িয়ে। নৈহাটির ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এসেছে। শিক্ষামূলক ভ্রমণে। আমাদের বিদায় জানিয়ে পুরেশ ওদের নিয়ে চলে গেল নাগজিরা দেখাতে। কোন নতুন অভিজ্ঞতার সন্ধানে। আমরা চললাম গোন্ডিয়া ষ্টেশনের রিটায়ারিং রুমে। বন্ধু গিরি বাবুর কল্যানে ট্রেনে ফেরার সময় বারবার মনে হচ্ছিল সেই রোমাঞ্চকর ৪৫ মিনিটের অভিজ্ঞতা।
থাকার জন্য হলিডে হোম(৮টি দ্বিশয্যা), লতাকুঞ্জ(৩টি দ্বিশয্যা), মধুকুঞ্জ(২টি দ্বিশয্যা, লগহাট(২টি স্যুট), নিলয়(৩টি স্যুট- সুপারিশ থাকলে) ও ডর্মেটরি(৪৪টি শয্যা)। ড্রাইভার ও গাইডের খাওয়ার খরচ ট্যুরিস্টের। বর্তমান প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ০৭১৮৪-২৫২৪০৬ এই ফোন নম্বরে।