বাজেটের পর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। টিভি বা সংবাদপত্রে অর্থনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া পড়ে আমরা জেনেছি যে ডিমনিটাইজেশন বা নোটবন্দী পরবর্তী বাজেটে সরকার সাবধানে পা ফেলেছে, কোনও কঠোর পদক্ষেপের ঝুঁকি নেয়নি এবং আসন্ন নির্বাচনগুলির কথা মাথায় রেখে কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে আর্থিক বরাদ্দ বহুলাংশে বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়তঃ, চাহিদা বাড়ানোর লক্ষে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গৃহ-নির্মাণ প্রকল্প অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু ইনকাম ট্যাক্সে যা ছাড় ঘোষণা করা হয়েছে, তা মধ্যবিত্তের আশাকে ছুঁতে পারেনি।
বাজেটের হিসাব-নিকেশগুলি খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যাবে, কৃষি ও গ্রামীণ বিকাশের ক্ষেত্রে বরাদ্দ সত্যিই অনেকটা বেড়েছে। নীচের সারণী থেকে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে-

farmer tractor-bitarka

কৃষি ও গ্রামীণ বিকাশের ক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধি অবশ্যই কাম্য কিন্তু ভারতের কৃষি সংক্রান্ত সমস্যা গত এক দশক ধরেই তীব্র আকার ধারণ করেছে। দেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে, ইউপিএ সরকারও দ্বিতীয় কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিল। বিভিন্ন বছরের বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধিও করেছিল কিন্তু কৃষকের আত্মহত্যা বন্ধ হয়নি। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা যদি শতকের ঘরে থাকে, তাহলে বলতে হবে বছরটা ভালো কাটল। এটা এই সরকারের চতুর্থ বাজেট কিন্তু কৃষি  নিয়ে একটা সুসংহত পরিকল্পনা এখনও পর্যন্ত তারা তৈরি করে উঠতে পারল না ।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে এই সরকার নীতি আয়োগের ভাইস-চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে একটি কৃষি উন্নয়ন সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। গত বছর উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশ অনুসারে, সরকার কৃষকদের ফসল বিক্রির সুবিধার্থেe- NAM বা একটি National Agriculture Marketপোর্টাল তৈরি করেছে। e- NAM পোর্টালের মাধ্যমে চাষীরা তাদের উৎপন্ন ফসল স্থানীয় কৃষি বিপণন কেন্দ্র থেকে ভারতের যেকোনও প্রান্তের ব্যবসায়ীকে বিক্রি করতে পারবেন। ফলে, চাষীরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন। ২০১৭-র বাজেটে এই সুবিধা ২৫০ থেকে ৫৮৫-টি  কৃষি বিপণন কেন্দ্রে সম্প্রাসারিত করার কথা বলা হয়েছে। তবে, গতবারের চালু কেন্দ্রগুলি এখনও পুরোপুরি কাজ শুরু করতে পারেনি। দ্বিতীয়তঃ, বছরে ২৫০-৩০০ কৃষি বিপনণ কেন্দ্রকে এই প্রকল্পের অধীনে আনা হলে, দেশে চালু আড়াই হাজার কৃষি বিপণন কেন্দ্র ও তার অধীন প্রায় পাঁচ হাজার চাতালে(auction yard)e- NAM চালু হতে বছর পনেরো লাগবে।
ভারতবর্ষের কৃষিনীতি এখনও মূলত কৃষি-পণ্যের মূল্য সহায়ক (support price)নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ, চাষীকে আর্থিক সহায়তা করার কারণেই হোক বা কোনও কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনেই হোক – কৃষি-পণ্যের মূল্যের হেরফের করেই ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যেমন হালে ডালের ক্ষেত্রে হল। বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা বলছে্ন – যেমন সঠিক মানের বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ, কৃষিপণ্যের বাজারদর নির্ধারণে কৃষকের অধিক ক্ষমতায়ন, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য উন্নতমানের শিক্ষার প্রসার এবং গ্রামাঞ্চলের পরিকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন ইত্যাদি। (উৎসাহী পাঠক, এই বিষয়ে এম এস স্বামীনাথন লিখিত একটি প্রবন্ধ পড়ে দেখতে পারেনঃ https://governancetoday.co.in/what-ails-indias-agriculture/)
এইসমস্ত বিষয় নিয়ে বাজেটে একটা দিশা থাকা দরকার ছিল কারণ সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়া পাঁচ বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা অসম্ভব। অথচ, এটা এই বাজেটের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অঙ্গীকার।
 আমাদের দেশে, উদারীকরণের বিরোধীরা সবসময়ে “jobless growth”- এর কথা বলে থাকেন। গত সাত-আট বছরের হিসাব ধরলে বক্তব্যটা অনেকাংশে সত্যি।  এর জবাব হিসাবে ‘মেক-ইন-ইন্ডিয়ার’ ভবিষ্যতের ছবি আঁকা হয়। এই বাজেটেও হয়েছে। ভারতবর্ষে যেহেতু ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের আশানুরূপ বৃদ্ধি হয়নি, হয়েছে পরিষেবা ভিত্তিক শিল্পের, তাই জাতীয় আয়ের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটলেও, সাধারণ মানুষ কাজ পায়নি। কথাটা সত্যি, কিন্তু আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে কি ভারতবর্ষে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে উৎপাদন এমন পর্যায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব, যেখানে এই ক্ষেত্র থেকে দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া এবং সর্বপরি চিন যেভাবে জাতীয় আয় ও ব্যাপক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করেছে, তা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে? বিশ্ব-বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের সেরা যুগ বোধহয় ছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে এই শতাব্দীর প্রথম দশক অবধি -আমরা সেই বাস মিস করেছি। এখন আমদানীর উপর  নানারকম শুল্ক শুধু আমেরিকা নয়, আরও বহু দেশেই বসাতে পারে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চিন তো হাজার অছিলায় বিদেশী পণ্য ঢুকতেই দেয় না। বিশ্ব-বাণিজ্য সংস্থার ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে গোটা বিশ্বে পণ্য বাণিজ্য বেড়েছে মাত্র ২.৫ শতাংশ হারে।  সুতরাং, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চিন যেভাবে উন্নতি করেছে, তা আমাদের পক্ষে আজ প্রায় অসম্ভব।
দ্বিতীয়তঃ, একবিংশ শতাব্দীর ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের উৎপাদন পদ্ধতি গত শতাব্দীর পদ্ধতি থেকে অনেকাংশে ভিন্ন। এখন দ্রুত অটোমেশন, রোবটের ব্যবহার চলে আসছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম কিম হালে ব্রুকলিনের একটি আলোচনা সভায় বলেছেন যে বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে আগামী বছরগুলিতে ভারতবর্ষে ৬৯ ও চিনে ৭৭ শতাংশ কর্মসংস্থান অটোমেশনের কারণে কমতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি সার্ভিসেসে ইতিমধ্যেই এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি সার্ভিসেস কোম্পানীগুলি ইতিমধ্যেই সাধারণ মানের কাজগুলিতে (repetitive job) অটোমেশন সফটওয়্যার চালু  করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।২০১৫ সালেই মাইক্রোসফটের ভারতীয় শাখার প্রাক্তন চেয়ারম্যান রভি ভেংক্টেশন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সার্ভিসেসের ভবিষ্যত সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন- “IT party is over. Now’s the time to reinvent or die”। সুতরাং, শিল্পোন্নয়ন ও কর্মসংস্থান নিয়ে এখনই নতুন চিন্তা-ভাবনা জরুরি। বাজেটে কিন্তু এর কোনও ইঙ্গিত নেই।
লেখক – অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি সচিব