অনেকদিন পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতির অন্দরমহল সম্পর্কে বেশ কতকগুলো কথা জানা গেল। দেশ ভাগ হয়েছে এতবছর কিন্তু দুটো দেশই নাবালক থেকে গেল। ভারত তো যেমন তেমন, পাকিস্তানের কথাই নেই। পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ভারতের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধের সময়সীমা বাড়িয়ে নিজের দেশের আস্থা অর্জনে ব্রতী হয়েছেন। কিন্তু তাতে সফল হয়েছেন বলে মনে হয় না। তার কারণ বেশিরভাগ পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ভারতের সঙ্গে, ভারতের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। শাসকের যে কান নেই তা তো ইতিহাসে বার বার প্রমাণিত।
খুরশিদ আহমেদ কাসুরি’র বইটি পেলাম সম্প্রতি। ‘নাইদার এ হক, নর এ ডোভ’। এই বই প্রকাশ নিয়ে যা কাণ্ড ঘটেছে তাতো একেবারে কালিঝুলি মাখা। কাসুরি(২০০২-২০০৭) পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন। এমন একটা বই লেখার ‘হক’ তাঁর আছে। তবে কাসুরি মানুষটি ভারি চমৎকার। বিলেতে শিক্ষিত। বাড়িতে বিশাল ঐতিহ্যময় রাজনৈতিক পরিবেশ। বাবা মিঞা মেহসুদ আলি কাসুরি, জুলফিকার আলি ভুট্টোর মন্ত্রী সভায় সদস্য ছিলেন। বনিবনা হয়নি। পদত্যাগ করেছিলেন। রাজনীতি ছাড়েননি। এমন একটা পরিবার থেকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হওয়াটা প্রায় ভবিতব্য। একটা ব্যাপার আমাকে আশ্চর্য করেছে, তাঁর সময়ে ভারতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছেন তিনজন। নটবর সিং, প্রণব মুখ্যোপাধ্যায় ও যশবন্ত সিং। তিনজনের সঙ্গেই মেহমুদ কাসুরির ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সমীকরণ খুবই ভালো। কারণটা কী? লাহোরের ৪ নং ফান রোডের একটি বাড়ির নাম ‘খোলা বাড়ি’। বিচিত্র পথ ও মতের মানুষের আনাগোনা সেখানে। হুসেন শাহেদ সুরার্বদী, জুলফিকার আলি ভুট্টো, খান আব্দুল গফফর খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মিঞা ইফতিকার উদ্দিন খাঁন, মজহার আলি খান, ফইয়াজ আহমেদ ফইয়াজ, মির্জা ইব্রাহিম, হাবিব জালিব। এদের মধ্যে কেউ গণতন্ত্রী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউ কবি, সাহিত্যিক, শ্রমিক নেতা। এই আনাগোনার মধ্যে কিশোর খুরশিদ মেহমুদ কাসুরির মনের ভিত্তিটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাঁর নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতি পারভেজ মুশারফ।
মুশারফ সম্পর্কে তার মন্তব্যই তার প্রমাণ। রাষ্ট্রপতি তাঁকে না জানিয়ে তার দপ্তরের কাজ করে ফেলেছেন। তিনি তখন বিদেশে। একটা ফোন করার সৌজন্যও দেখাননি। আধিকারিকদের কাছে শোনার পর পদত্যাগ করা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি। কিন্তু সৌজন্যে’র সীমানা পার হতে দেননি। আজ যেটা বিরল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর কাছে পারভেজ মুশারফের এটাই প্রথম প্রশ্ন ছিল, তাঁর কাজটা কেমন হবে? শিকারী পাখির মতো তীক্ষ্ণ অথবা কবুতর ওড়ানো শান্তি। কাসুরির কাছে কোন উত্তর ছিল না। ১৯৯৯ সালের কার্গিলের যুদ্ধ। ২০০১ সালে ‘আগ্রা সামিট’-এর অসাফল্য। তখন ভারতের আভ্যন্তরীণ অবস্থা খুব খারাপ। বিজেপি জোট সরকারে এসেছে, গুজরাটে সংখ্যালঘু নিধনের সময়, প্রধানমন্ত্রীর এক মুখ্যমন্ত্রীকে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ। এসবের প্রভাব পাকিস্তানে যথেষ্ট। তারই মধ্যেই খুঁজতে হবে রাস্তা। সেটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
বইটিতে আগ্রা সামিটের দারুণ এবং নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। কাকে বলে ‘বৈঠক’ তার চূড়ান্ত রূপ দেখা গিয়েছিল। আমিও চেন্নাই এর এক হোটেলে বসে মুশারফের সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রাতঃরাশ বৈঠক দেখেছিলাম। আমার মতো অনেকেই অভিভূত। চূড়ান্ত ঘোষণা সই করার সময় এলো। টেবিল চেয়ার পাতা শেষ। মুশারফ এবং তৎকালীন পাকিস্তানী বিদেশমন্ত্রী প্রাথমিক ভাবে খুশিই হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী সম্পর্কে প্রাতঃরাশ বৈঠকে সাংবাদিকদের মুশারফ বলেছিলেন, ‘‘প্রায় আমার বয়সের সমান সময় রাজনীতিতে আছেন। বুজুর্গ।’’ আমরা সবাই অপেক্ষা করছি শেষ অনুষ্ঠান দেখবো বলে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী মাত্র ১০ মিনিট সময় নিয়ে ঘোষনাটি চূড়ান্ত করতে গেলেন প্রধানমন্ত্রী ও এল কে আদবানী’র কাছে। কিন্তু ৩ ঘণ্টা কেটে গেল। ফিরে এসে বললেন ঘোষণা হচ্ছে না। আর এস এস এর বাধাতে ঘোষণা হল না। রাতেই প্রচার হয়ে গেল, বাজপেয়ী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন–আদবানী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। রাত্রি ২টো, মুশারফের বিমান উড়ে গেল ইসলামাবাদের দিকে। দেখা হলো না মইনুদ্দিন চিস্তির মাজার।
সোনিয়া গান্ধীর চওড়া হাসি শেষ পর্যন্ত তিনি টেনে আনতে পেরেছিলেন, এটা কাসুরির বড় কৃতিত্ব। ২০০৪ সালে পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতি’র সফর সঙ্গী ছিলেন তিনি। সেদিন মনমোহন সিং-এর সঙ্গে বৈঠক, সেদিনই ফিরোজ শাহ কোটলা তে ভারত-পাকিস্তান একদিনের শেষ ম্যাচ। আফ্রিদির বড় বড় ‘শট’ গুলো দেখে মনমোহন সিং পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলেন, ‘‘ছেলেটিকে আপনারা সঙ্গে নিয়ে যাবেন।’’ ম্যাচ এমন উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে, মুশারফ মাঠ ছাড়তে চাননি। তাই শেষ পর্যন্ত বৈঠক দেরিতে শুরু হয়। সেখানেই সোনিয়া গান্ধী’র সঙ্গে তাঁর দেখা। গম্ভীর মুখ, হাসতে মানা। কোনও কথাতেই চিঁড়ে ভেজেনি। কাসুরি দেখলেন সোনিয়া মুশারফের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। সঙ্গে নটবর সিং। কাসুরি এগিয়ে বলছেন, সেই সময়ের কেমব্রিজের কথা – মিঞা ইফতিকারুদ্দিন, যিনি পন্ডিত নেহেরু ও গান্ধীজীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর পুত্র শোহেল ইফতিকারকে নিয়ে যখন কিংস প্যারেডে যাচ্ছেন, তখন দেখছি একজন ‘হ্যান্ডসাম’ যুবক উল্টোদিকে রাস্তা পার হচ্ছে। কাসুরি শোহেল কে বলছেন, ‘ছেলেটি কে?’ শোহেল বলছেন ‘তুমি কিছুই জানো না, এ ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে, নেহেরুর নাতি।’ যেই সোনিয়া শুনেছেন রাজীব ‘হ্যান্ডসাম’ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিঃস্তব্ধতা ভেঙে চওড়া হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে উঠলেন ‘That is why I married him’। আসমা জাহাঙ্গীরের স্বামী তাহির জাহাঙ্গীর ফ্রাইডে টাইমস’এ লিখেছেন, Rajib and Sonia love at first sight– How a chance encounter in a Cambridge restaurant made an Italian language student the most powerful women in India. তাহির তাঁদের বন্ধুও বটে। খুরশিদ তাঁর আর এক বন্ধু মনিশঙ্কর আইয়ার’কে দিয়ে কাগজটি সোনিয়াকে পাঠিয়ে ছিলেন। কোনও প্রতিক্রিয়া অবশ্য জানা যায়নি।
এল কে আদবানী’র পাকিস্তান সফর ছিল খুবই আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। কাসুরির আহ্বানে তিনি পাকিস্তানে যান। তখন তিনি বিরোধী দলনেতা। আদবানী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী-সহ পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করেন। গড়বড় হয়ে গেল জিন্নাহ মুসোলিয়াম দেখতে গিয়ে। জিন্নাহকে অসাম্প্রদায়িক বলে মন্তব্য করলেন। আর যায় কোথায়? দেশে ফিরে দেখলেন বিমানবন্দরে আর এস এস পোস্টার দিয়েছে ‘পাকিস্তানপ্রেমী আদবানী ফিরে যাও পাকিস্তানে’। এমন কি কংগ্রেসও আদবানীর সমালোচনা করে। পরে মেহমুদ কাসুরি যখন আবার ভারতে এলেন, তিনি আদবানীর সঙ্গে দেখা করেন এবং বলেন- ‘আমি খুবই দুঃখিত। আমার নিমন্ত্রণে পাকিস্তানে গিয়েই আপনাকে এমন অবস্থায় পড়তে হল’। ততদিনে বিজেপি’র সভাপতির পদ থেকেও তাঁকে সরে যেতে হয়েছে। এই কথা বলার সাথে সাথে আদবানী উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁর আত্মজীবনীর একটা খণ্ড দিলেন কাসুরি কে। তাতে একটা অধ্যায়ই আছে ‘I Have No Regrets’।
বেনজির ভূট্টো এবং তিনি একই পার্টি করেননি। তবে বেনজিরের প্রশংসায় সব সময় পঞ্চমুখ ছিলেন। তাঁদের পারিবারিক সম্পর্ক ও যাতায়াত ছিল চোখে পড়ার মতো। বেনজির অনেক গোপন কথাও তাঁকে বলেছেন। একটি চমৎকার কথা উল্লেখ করতে চাই, বেনজির ভূট্টো কথা প্রসঙ্গে খুরশিদ’কে বলছেন- “আল্লা আমাকে রক্ষা করুন আমার শত্রুদের হাত থেকে, আর আসিফকে(তার স্বামী) রক্ষা করুন তার বন্ধুদের হাত থেকে”।
এই ধরনের বই মানেই রাজনীতি। তার উপর পাকিস্তানী হলে তো কথাই নেই। সে কারণে কাশ্মীর প্রসঙ্গ অবধারিত। তবে প্রশংসা করতে হয় নানা প্ররোচনা সত্ত্বেও কাসুরি বাধা ও চেনা ছকের বাইরে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে গেছেন। ২০১০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী বা পররাষ্ট্র দপ্তরে অতীতে কাজ করেছেন, কিন্তু এখন রাজনীতিতে, তাঁদের সভা ডেকেছিলেন তাঁর নিজের বাড়িতে। আব্দুল সাত্তার, মনিশঙ্কর আইয়ার গহর আইয়ুব, যশবন্ত সিং, সরতাজ আজিজের মত মানুষরা উপস্থিত ছিলেন।
একটা বিরাট বই। ৮৫০ পাতার বই পড়া যে কোন মানুষের কম্ম নয়। পড়ার চেষ্টা করা যায় তার কারণ লিখনশৈলী ও ভাষাজ্ঞান আকাশছোঁয়া। আর কোনও কোনও সময় ভারত-পাকিস্তান একদিনের ক্রিকেট ম্যাচের মতোই উত্তেজক।
লেখক- প্রাক্তন সাংসদ ও কলামিস্ট।