সথপন্থের পথে, সামনে চৌখাম্বা। ছবি- সপ্তক ব্যানার্জী।
অর্ঘ্য’র সাথে কথা বলে জেনে নিলাম আমাদের ট্রেন  ১১ ই জুন দুপুর ১২.২০ মিনিটে কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়বে, সময় মতো পৌঁছে গিয়ে দেখি প্রায় সবাই চলে এসেছে। সবার সাথে দেখা করে আমি, শুভদা  (শুভজিত ভট্টচার্জ) , শাশ্বত (শাশ্বত ব্যানার্জী),  ও অর্ঘ্য (অর্ঘ্য পাঠক) দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম জনআহারে। তারপর বাকিরা এলে ট্রেনে উঠলাম, বুগিয়ানা এক্সপ্রেস। পরের দিন সকাল ১০.৩০ মিনিটে পৌঁছলাম সাহারানপুর, সেখান থেকে হরিদ্বার হয়ে গাড়ি চলল রুদ্রপ্রয়াগের উদ্দেশ্যে।
এবারে আমরা যাচ্ছি সথপন্থের পথে। ১৫৭৫০ ফুট মানে ৪৮০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত সথপন্থ তাল (হ্রদ) এক ধর্মীয় স্থান। কথিত আছে বদ্রিনাথের মানা গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করে এই পথেই স্বর্গের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন পাণ্ডবরা, তাই এই পথকে মহাপ্রস্থানের পথও বলে। আরও কথিত আছে প্রতি একাদশীর দিন এই হ্রদের তিন দিকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ধ্যানে বসেন।
১৩ ই জুন রুদ্রপ্রয়াগের  কালিকমলি ধর্মশালা থেকে চেক আউট করে আমরা নয় জন রওনা হলাম বদ্রিনাথ এর উদ্দেশ্যে। আমাদের দলের বাকিদের সাথে পরিচিতিটা গাড়িতে যেতে যেতে সেরে ফেলি। সাথে আছে জেঠু (বরুন কুমার ভট্টচার্জ) ও জেঠিমা (ইতু ভট্টচার্জ) , প্রদীপদা (প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী), গলু (অর্ণব কুমার সাহা) এবং গলুর স্ত্রী (শঙ্খনীলা মজুমদার) বাকি আমরা চারজন যাদের পরিচিতি আগেই হয়েছে। যোশীমঠ হয়ে বদ্রিনাথ পৌঁছতে আমাদের বেজে গেল বিকেল তিনটে। ওই দিন আমরা বদ্রিনাথেই থাকব। পৌঁছে সবাই পুজো দিল। কাল সকালেই আমাদের প্রধান যাত্রা সথপন্থ তালের উদ্দেশ্যে।

মানা থেকে লক্ষ্মীবন ( ১০ কিমি)

অর্ঘ্য’র (আমাদের দলপতি) সাথে কথা বলে ঠিক করা হল  জেঠু , জেঠিমা ও প্রদীপদা একটু আস্তে চলবে, তাই তাদের নিয়ে  অর্ণব ও শঙ্খনীলা আগে এগিয়ে যাবে, আর আমরা বাকি চারজন পরে গাইড ও পোর্টারদের সাথে যাব। আমি আর অর্ঘ্য যাত্রা শুরু করলাম মহাপ্রস্থানের পথে। মানার ব্রিজ পেরিয়ে সুন্দর ঘাসের পথ পাহাড়ের কোল ঘেষে চলেছে। ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর প্রায় দুশো মিটারের একটা ঢাল, ঢালটা নেমে গিয়ে পাহাড়ের বাঁকে রাস্তাটা মিলিয়ে গিয়েছে। সেই বাঁকে পৌঁছতেই আমদের সামনে এল প্রথম পাথুরে কঠিন পথ। ঝুরো পাথরের পথ উঠে গেছে প্রায় পঞ্চাশ ফুট, একপাশে অলকানন্দা গর্জন করে চলেছে।  সেই পথ পার হতেই একটা কঠিন বরফের চাদর। সেটা পার করে আমরা সবাই আবার চললাম লক্ষ্মীবনের উদ্দেশ্যে। পথে সঙ্গ নিল তিন ধর্মরাজ মানে তিনটি কুকুর। ঘণ্টা চার যাওয়ার পর পৌঁছলাম চামতলি ক্যাম্প সাইট। সেখান থেকে কিছুদূর গিয়ে আমারা আমাদের দুপুরের খাবার খেয়ে আবার চলতে শুরু করলাম ঘাস আর ছোট গুল্ম জাতীয় গাছে ভরা উঁচু নিচু পাহাড়ের ঢালের মধ্যে দিয়ে। লক্ষ্মীবন পৌঁছলাম বিকেল তিনটে নাগাদ। পৌঁছতেই আমাদের জন্য চা আর ভাজাভুজি চলে এল। জায়গাটা বেশ সুন্দর, পাহাড়ের ঢালে অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলা মাঠের মতো, একপাশে সোজা নাম না জানা এক উচ্চ শৃঙ্গ দাঁড়িয়ে। কথিত আছে এইখানে মহাপ্রস্থানের পথে দ্রোপদী মারা গিয়েছিলেন। তবে আমাদের প্রত্যেকেরই শরীর ভাল ছিল।

লক্ষ্মীবন থেকে চক্রতীর্থ (৮-১০ কিমি)

সকাল ছ’টা নাগাদ লিকার চা’এর ডাকে ঘুম ভাঙল, আবহাওয়া খুবই সুন্দর। তৈরি হয়ে সাতটা’র মধ্যে উপস্থিত হলাম খাবারের টেন্টে। সবাই মিলে সকালের খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম  চক্রতীর্থ-এর দিকে। আজ পথ কঠিন হবে সবাই জানতাম, তবে ত্রিশ মিনিট চলার পর শুরু হল ছোট গুল্ম গাছে ভরা পাথরের রাস্তা আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট জলধারা, যেগুলো দেখতে ছোট হলেও পার হওয়া মাঝে মাঝে বেশ কঠিন হয়ে উঠছিল। এই পাথরের রাস্তা দিয়ে চলার কিছুক্ষণ পর এল বান্ধার। এখানে অনেকে ক্যাম্প করে কিন্তু এখানে না আছে টেন্ট খাটাবার জায়গা, না আছে জলের সুবিধা। এখানে জল পেতে গেলে দু’কিমি এগিয়ে জল আনতে যেতে হয়। আমরা বান্ধার টপকে একঘণ্টা যেতেই বা’দিকে চোখে পড়ল একসাথে অনেক ঝরনা, তবে বেশ দূরে। মন ভাল হতে লাগল অপরূপ দৃশ্য দেখে। আর আমাদের সঙ্গ ছাড়ল সেই তিন ধর্মরাজ-এর শেষ ধর্মরাজ। পাথরের জঙ্গলে চলার মাঝে এক বড় ঝরনা থেকে বেড়নো পর পর অনেক জলধারা আমাদের সামনে উপস্থিত হল। সেগুলো পার হলাম এবং তারসাথে এক ছোট নদী পেরতে হল। সেখানের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে আমি আর অর্ঘ্য রয়ে গেলাম আরও কিছুক্ষণ। বাকি দলকে এগিয়ে যেতে বলা হল। আমরা সেখান থেকে বেড়নোর সময় অন্য একটি দল আসছিল, তাদের নদী পার হতে সাহায্য করে আমরা আবার একটু জোরে চলতে শুরু করলাম নিজেদের দলের কাছে পৌঁছতে। একপাশে অনেক ঝরনা আর অন্যপাশে পাথরে মোড়া অলকাপুরী হিমবাহ, মনোরম দৃশ্য। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কোথা থেকে মেঘ ঢুকে সব দৃশ্য গ্রাস করল,  শুরু হল বৃষ্টি। প্রথমে আস্তে এবং পরে বেশ জোরে। আমি সাথে বর্ষাতি বা ছাতা কোনওটাই নিয়ে যাইনি। তাই মাথায় একটা প্লাস্টিক দিয়ে পথ চললাম। একে রাস্তা দুর্গম হয়ে উঠেছে তার ওপর বৃষ্টি। পথ চলা খুবই কঠিন হয়ে উঠল, চলার গাতিবেগও কমে গেল আমাদের। তাই ঠিক হল আমরা আজ ক্যাম্প চক্রতীর্থে না করে সহস্রধারায় করব। কিন্তু সহস্রধারায় পৌঁছে দেখলাম মালবাহকরা আগেই চলে গিয়েছে, তাই আমারাও এগোলাম চক্রতীর্থের দিকে। চারিদিকে সাদা পাহাড়ে ঘেরা সহস্রধারা জায়গাটি যেন এক মায়াবী সুন্দরীর মতো। পাহাড়ের কোলে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে সমতল ঘাস, একটি নদী নেমে অনেক ধারা তৈরি করেছে এখান সেখান দিয়ে। সেই অপরূপ স্থান ছেড়ে আমরা আবার এগিয়ে গেলাম পাথরের সমুদ্রের মধ্যে। সহস্রধারা পেরোতেই প্রায় তিনশো মিটারের খাড়া পাহাড় দাঁড়িয়ে। শুধু বড় বড় পাথর, কিছু দূর ওপরে ওঠার পর সামনে আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু আমারা থামার নই, সেই পাহাড় টপকে আরও একটা বরফের চাদর টপকাতেই পাথরের সমুদ্রে গিয়ে পড়লাম। কোনও পথ বলে কিছু নেই, চারিদিকে শুধু ছোট বড় পাথর। সেই পাথরের ওপর দিয়ে গাইড আমাদের ঠিক পথ দেখিয়ে নিয়ে পৌঁছল চক্রতীর্থ। যখন পৌঁছলাম তখন সবাই প্রায় ভিজে কাক আর খুবই ক্লান্ত। কোনওরকমে আমি টেন্টে  ঢুকে জামাকাপড় পালটে যখন খেতে বেরোলাম ততক্ষণে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। হেডটর্চ জ্বেলে এগোতেই বুঝলাম চারিদিক মেঘে ঢেকে আছে, পাশের টেন্টটাও দেখা যাচ্ছে না। কোনওক্রমে খাবার টেন্টে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে একটু কথাবার্তা সেরে আবার সবাই যে যার টেন্টে শুয়ে পড়লাম ।

চক্রতীর্থ থেকে সথপন্থ তাল (৬ – ৮ কিমি)

আজ আমাদের পথ চলতে হবে ছ’কিমি মতো, তবে রাস্তা খুবই কঠিন। আমরা সকালের খাবার খেয়ে যাত্রা শুরু করলাম মহাপ্রস্থানের পথে। প্রথম কুড়ি মিনিট সমান হাঁটার পর এক বিশাল চড়াই সামনে। প্রায় পাঁচশো মিটার উঠে গিয়েছে। এই পাঁচশো মিটার চড়তেই আমাদের চারজনের (মানে জেঠু, জেঠিমা, প্রদীপদা ও আমি) সময় লেগে গেল প্রায় দু’ঘণ্টা। বাকিরা আগে চড়াই টপকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সবুজ পাহাড় চড়ে যখন শিখরে পৌঁছলাম আমাদের বাকি সঙ্গীদের সাথে সামনে এল এক অবাক দৃশ্য। চারিদিক রুক্ষতায় ভরে গিয়েছে, শুধু পাথর আর পাথর, মোরেনের পর মোরেন চলে গিয়েছে সামনে। সেই রুক্ষতা ভরা মোরেনের সমুদ্র দেখে মনে ক্লান্তির বদলে একটা স্নিগ্ধতার সুখ ছুঁয়ে গেল। কিছুক্ষণ বসে সেই মায়াবী পরিবেশ উপভোগ করে আবার পথ চলা শুরু হল। সামনে শুধু মোরেনের পর মোরেন। ভাল গাইড না থাকলে পথ ভুল করে ক্রিভার্সে পরে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এখন আমাদের সঙ্গী হিসাবে রইল ডান পাশে বিস্তীর্ণ অলকাপুরী হিমবাহ। একটার পর একটা মোরেন পার হতে থাকি আর আমাদের ক্লান্তি বাড়তে থাকে। পথে দুটো ছোট ছোট ক্রিভার্স পড়ল, লাফ দিয়ে আমরা সেগুলো পার হলাম। অবশেষে আমাদের ক্লান্তির বাঁধ ভাঙল। মনে এক পরিচিত আনন্দের ছোঁয়া লেগে গেল, চোখ দুটো যেন সার্থক হল। চারিদিক মেঘে ঢাকা পাহাড়ের মাঝে বিশাল ত্রিভুজ আকৃতির সথপন্থ তাল। জেঠু, জেঠিমা ও প্রাদীপদা’র চোখে আনন্দধারা বয়ে গেল। সবার শরীরে ক্লান্তি যেন কোথায় হারিয়ে গেল। তালের পাশে একটা উঁচু ফাঁকা জায়গা সেখানে একটা ছোট্ট মন্দির তার সামনেই আমাদের টেন্টগুলো বিক্ষিপ্ত ভাবে পাতা হয়েছে। সেখানে পৌঁছতেই আমাদের জন্য গরম গরম কফি চলে এল। সবাই মিলে খাবার টেন্টে গিয়ে যখন বসলাম তখন ঘড়িতে চারটে বাজে। সেখানে বসে ঠিক হল যদি কাল ভোরে আবহাওয়া ঠিক থাকে তো দলের কিছু সদস্য ওপরে যাবে আর বাকিরা ফিরতে শুরু করবে, যারা ওপরে দিকে যাবে তারা পরে রাস্তায় বাকিদের ধরে নেবে।

FB_IMG_1482826596849

সথপন্থ তাল। ছবি- সপ্তক ব্যানার্জী।

সথপন্থ পেরিয়ে

যা ঠিক হল তাতে শুধু আমি আর অর্ঘ্য  কাল ওপরে যাব, বাকিরা ফিরতে শুরু করবে। আজ আমি ও অর্ঘ্য একটা টেন্টে। কাল ভোর ৩.৩০ এ আমরা বেড়বো স্বর্গারোহিনীর পথে। রাতে খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হল। দু’জনেরই মন খারাপ হয়ে এল। ৩.৩০ এ অ্যালার্ম বাজতেই টেন্টের চেনটা খুলে মুখ বাড়াতেই চোখের সব ঘুম উড়ে গেল,  সামনে চাঁদের আলোয় অপরূপ রূপে সেজেছে রুপালি চৌখাম্বা। তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। এক কাপ চা খেয়ে আমরা তিনজন রওনা হলাম স্বর্গারোহিনীর পথে (আমি, অর্ঘ আর দেবেন্দর আমাদের গাইড)। প্রথমে কিছু পথ টর্চ হাতে চলতে হল, কিছু পরেই চোখ সয়ে গেল। সথপন্থ তালের এক পাশে আমাদের টেন্ট, তালের পিছন দিকে সুউচ্চ সথপন্থ পাহাড় দাঁড়িয়ে আর অন্য পাশের পাহাড়ের গা দিয়ে ক্ষীণ রাস্তা ধরে আমরা চলা শুরু করলাম। দুর্গম পথ। এখানে আসার আগে অনেক রিজ ওয়াক’এর কথা শুনেছিলাম, তবে সেটা যে এতটাই কঠিন তা বুঝতে পারিনি। পথ চলতে গিয়ে টের পাচ্ছি, একটা মোরেন টপকে বেশ কিছুটা উঠতেই সামনে দেখলাম অসাধারণ বিশাল চৌখাম্বা দাঁড়িয়ে। আর সামনের রাস্তা ! ওটাকে কোন ভাষাতে রাস্তা বলে জানি না, তবে ওটাই যাওয়ার পথ। ঠিকমতো পা ফেলার মতো জায়গা নেই, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দম নেওয়ার সুযোগ নেই। এক পাশে সোজা নেমে গেছে আনুমানিক ৫০০০ ফুট, আর অন্য পাশে একটু ঢাল হয়ে (সেটাও প্রায় ৭৫-৮০ ডিগ্রি খারাই) নেবে গেছে ১৫০০ ফুট মতো। সেই দুর্গম পথ আমাদের মনে যত না দাগ কাটল তার থেকে বেশি দাগ কাটল ডানদিকের বালাকুন্ড, সামনে চৌখাম্বা, তার পাশে ছোট স্বর্গারোহিনী, আর বামদিকে পার্বতী ও সথপন্থ শৃঙ্গ’এর অসাধারণ দৃশ্য। এই পথ চলার একটা বড় সমস্যা হল পথ দাঁড়ানো যায় না। একটু গন্ডগোল হলেই পা পিছলে নির্ঘাত মৃত্যু। ঘণ্টাখানেক চলার পর একটা উঁচু জায়গাতে আমরা বসে রেস্ট নিলাম। তারপর শুরু হল কঠিন মোরেন পার হওয়া।  এখানে পাথরগুলো সবাই সবার একে অপরের উপর রাগ করে আছে। কেউ কারুর সাথে লেগে নেই বললেই চলে। যেটাতেই পা দিচ্ছি সেটাই নড়ছে। একটা সময় হল যেখানে চার হাত-পায়ে চলতে হচ্ছে, গতানুগতিক ক্লাইম্বিং না হলেও সোজা চার হাত-পায়ে ওঠা। বেশ কিছুক্ষণ অন্তর পাহাড় গর্জে উঠছিল, প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝলাম বা’পাশে পাহাড়ে তুষার ধস মানে এভালাঞ্চ হচ্ছে। সেইভাবে কিছু পথ গিয়ে আমরা পৌঁছলাম চন্দ্রকুন্ড। বা’পাশে আনুমানিক ১০০০ ফুট নিচে একটা জলাশয়, সেটাই চন্দ্রকুন্ড। সেখানে কিছু টেন্ট দেখে আমরা অবাক হলাম, দেবেন্দ্র বলল “ওরা হিমবাহ মাপতে এসেছে, মাসখানেক আছে”। দু’পা এগোতে না এগোতেই সামনের চৌখাম্বায় দিনের প্রথম কিরণ পড়তেই চারিদিক একটা লাল আভাতে ভরে গেল, আর বালাকুন্ড ও চৌখাম্বা’র মাথা দুটো অসাধারণ লালচে রঙ ধারণ করল। এই দৃশ্যর জন্যই তো এত কষ্ট করা, এত কঠিন পথ পেরিয়ে এত দূর আসা। কিছু দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করে আবার এগোলাম আমরা, এখন পথ আরও দুর্গম হয়ে উঠেছে, ক্যামেরাটা দেবেন্দ্রর হাতে দিতে বাধ্য হলাম, না হলে ক্যামেরা সামলাতে গিয়ে আমার ইহলীলা সাঙ্গ হত। বেশ কিছুটা পথ হাঁটলাম। তারপর আবার একটু বিশ্রাম, সামনে দূরে সূর্যকুন্ড আর পেছনে চন্দ্রকুন্ড। চারিদিকে অপরূপ সুন্দরভাবে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট শৃঙ্গগুলো। তখন ঘড়িতে ৭.৪০। দেবেন্দ্র অর্ঘ্য’র সাথে কথা বলে জানালো আমরা ফিরলে তবে মালবাহকেরা বেরোবে, তাই আমাদের সামনের যাত্রা এখানেই শেষ। মনটা একটু ভরে এল, তারপর দু’চোখ ভরে চারিদিক দেখতে থাকলাম, ডানদিকে বালাকুন্ড, সামনে বিশাল চৌখাম্বা, তার পাশেই স্বর্গারোহিনী হিমবাহ, হিমবাহর গা দিয়ে সোজা উঠে গিয়ে মাথাটা বুড়ো আঙ্গুলের মতো স্বর্গারোহিনী শৃঙ্গ, তারপাশে পার্বতী শৃঙ্গের অবস্থান, তারপর সথপন্থ শৃঙ্গ, ও একদম পেছনে যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে নারায়ণ শৃঙ্গ, দেখলে মনে হয় ওটাই নীলকণ্ঠ। আর বালাকুন্ড ও আমাদের মাঝে আছে ৫০০০ ফুটের ঢাল ও বিস্তীর্ণ হিমবাহ। আমরা তার মাঝে প্রায় ৫২০০ মিটার উচ্চতায় বসে সেই পরিচিত কিন্তু অজানা বিশাল নির্জীব কিন্তু প্রাণবন্ত শৃঙ্গের নিশ্চল গতিবিধি উপভোগ করতে লাগলাম। এবার আমাদের ফেরার পালা। চোখটা কখন ঝাপসা হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি।