ভারতীয় রাজনীতির একটা বড় আলোচ্য বিষয় বহুকাল ধরে ছিল তার গণতন্ত্রের বিশ্লেষণ। ভারত কে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। ১৯৯০ এর দশকে তো গণতন্ত্র-কে আরও প্রতিহত করার জন্য সংরক্ষণের রাজনীতি শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেকার জাতপাতের রাজনীতির সাথে তাল মিলিয়ে। তবে এই গণতন্ত্রের গভীরতার সবথেকে বড় নিদর্শন হল আঞ্চলিক দলীয় রাজনীতির ও জোট রাজনীতির উত্থান। তবে একবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় রাজনীতির গণতন্ত্র আক্ষরিক অর্থেই এমন কিছু পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে যা গণতন্ত্রের সাবেক পশ্চিমী ধারণা থেকে সরে এসে এক নতুন ধরণের সমকালীন উত্তর ঔপনিবেশিক তৃতীয় বিশ্বের নিজের মত গণতন্ত্র তৈরি করেছে। এইখানে  কেন্দ্রীয় ভাবে জোট সরকার চলে তবে জোটবদ্ধ দলগুলি রাজ্য রাজনীতি-তে একে অন্যের বিপক্ষে সওয়াল করে, এখানে রাজনীতি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়, এখানে জনপ্রিয় নেত্রী হাজতবাসে যায় দুর্নীতির অভিযোগে আবার ফিরে এসেই মুখ্যমন্ত্রী হয় জয়ধ্বনীর মধ্যে, এখানে টাকা তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত হয়েও রাজনৈতিক দল দিব্বি ভোটে জিততে থাকে, এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সবথেকে বড় কান্ডের নেতা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যায় আর পবিত্র গঙ্গার নামে শপথ নেয় ভারত-কে আবার বিশ্বের দরবারে শীর্ষ আসন দেওয়ার জন্য। এগুলো কে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এক কথায় বলা যায় গণতন্ত্র ‘মাটি’ হয়ে গেছে বা গণতন্ত্র নষ্ট হতে বসেছে গভীর গণতন্ত্রের নামে।

সৎ, চরিত্রবান, বিনয়ী, নম্র, পরোপকারী, জন-নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন, সম্মোহনীয় ব্যক্তিত্ব ও মাটির মানুষ- এইটাই হল জনগণের চোখে দেশের গণতন্ত্রের নেতৃত্ব দেওয়ার সবথেকে যোগ্যতম নেতৃত্ব। মহাত্মা গান্ধীর মত মাটির মানুষের বেশভূষণ তাঁকে মহাত্মা উপাধি ও বাপুজি নামে পরিচিত করেছিল। ভারতীয় রাজনীতির এই মাটির সাথে সম্পর্কযুক্ত রাজনীতি কে অন্যভাবে বলা হয় পরিবেশ রাজনীতি(সুন্দরলাল বহুগুনা ও তার চিপকো আন্দোলন, মেধা পাটেকারের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন), জমি আন্দোলন রাজনীতি (ভূদান, গ্রাম দান রাজনীতি বিনোবা ভাবের নেতৃত্বে) এবং বর্তমানে স্বচ্ছ ভারত তৈরি করার উদ্যোগ। তবে মাটি নাম কে রাজনীতির একদম সামনের সারিতে নিয়ে আসার কৃতিত্ব হল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর। যিনি তার সরকারের নামকরণ করেছেন- মা মাটি ও মানুষের সরকার হিসাবে। মাটি নিয়ে অবশ্য যারা এক কালে ভারত জুড়ে আলোড়ন তুলেছিলো তারা হল বামপন্থী দলগুলি। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের আমূল বদল ঘটিয়েছিল। অবশ্য মাটি নিয়ে টানাটানি করতে গিয়েই(পড়ুন চাষের জমি নিয়ে টানাটানি শিল্পের নামে) তাদের তিন দশকের শাসনকাল মাটি হয়ে গেল এবং ২০১১ সালে তাদের পরাজয় ঘটলো। বর্তমানে বামপন্থী দলগুলিকে রাজনৈতিক মতাদর্শগত শক্ত মাটির ভিতে দাঁড় করানোই তাদের নেতৃত্বের কাছে বড় পরীক্ষা। পশ্চিমবঙ্গে তো এক অর্থে বর্তমানে মা মাটি মানুষের ঝড়ের সামনে বামপন্থীদের মাটি ও গ্রাম ভিত্তিক রাজনীতি নির্মূল হতে বসেছে!

১৯৯২ সালে ডিসেম্বর মাসে যারা বাবড়ি মসজিদকে ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার সংকল্প নিয়েছিল, যারা ২০০৩ সালে গোধরা কান্ডের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতির মাটি তে মিশিয়ে দিয়েছিল, সেই ভারতীয় জনতা দল বা বিজেপি আজ কেন্দ্রে ক্ষমতায়! জনগন কি তাদের অতীত কে ভুলে গেল বা ক্ষমা করে দিল? না, সেই সরলীকরণ করা ঠিক নয়। ভারতীয় রাজনীতির বিশিষ্ট বিশ্লেষক অতি সম্প্রতি প্রয়াত রজনি কোঠারি একদা কংগ্রেস ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন ১৯৭০ দশকে কংগ্রেস দলের একচ্ছত্র আধিপত্যের ব্যখ্যা করতে গিয়ে। আজ তার মৃত্যুকালে আবারও একটি বিশেষ দলের একচ্ছত্র আধিপত্যের(তবে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় স্তরে)প্রকাশ পেয়েছে। এর কারণ হল এই দলের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা অর্থাৎ হাল না ছেড়ে দেওয়ার মনোভাব এবং কংগ্রেস দলের নেতৃত্বের মান প্রায় মাটি তে মিশে যাওয়ার মতো তলানিতে চলে আসা। কংগ্রেসকে রাহুল গান্ধী বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছেন মাটির আন্দোলনের মাধ্যমে (কেন্দ্রীয় সরকারের জমি বিলের বিরোধিতা করে)।

দেশের প্রাধানমন্রী তার শপথ নিলেন গঙ্গা বক্ষে গঙ্গা জল ও গঙ্গা মাটি ছুঁয়ে- এটাও এক নতুন অভিজ্ঞতা! একে দুভাবে ব্যখ্যা করা যায়- এক, ভারতীয় গণতন্ত্র মাটি তে পা রেখে চলছে অর্থাৎ তাদের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে, আর দুই, ভারতীয় রাজনীতির মান মাটি তে এসে ঠেকেছে অর্থাৎ একদম তলানিতে এসেছে আগেকার দিনের গাম্ভীর্য ও শিক্ষিত কাঠামোর থেকে সরে এসে। বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী কিন্তু একদম মাটি থেকে রাজনীতির পথ নিতে নিতে পর্যায়ক্রমে দলীও শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছেন যা আসলে ভারতীয় রাজনীতির সাধারনের ক্ষমতার স্বীকৃতি। পরিবেশ সুন্দর রাখতে মোদীজীর স্বচ্ছ ভারত অভিযানও তো এক অর্থেই আমাদের দেশের মাটি কে সম্মান দেওয়া, তাকে কলুসিত না করে সুন্দর রাখা।

তবে যদি মাটি এবং মাটির রাজনীতি, মাটির রাজনৈতিক ভাষ্য কে জনপ্রিয় করে তোলা কে বোঝান হয়, তবে যার কথা বলতেই হবে তিনি বিহারের রাজনৈতিক নেতা লালু প্রাসাদ যাদব। বিহারের রাজনীতি ভারতীয় রাজনীতিকে এক আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। লালু যতই দুর্নীতিতে জড়াক, তাঁর দেহাতি ভাষাশৈলী ভারতীয় রাজনীতির প্রথাগত ভাষাশৈলী-কে সর্বপ্রথম নাড়া দিয়েছিল একথা অনস্বীকার্য। আগের দিনের ‘বিমারু’(পিছিয়ে পরা রাজ্যের সংকলিত শব্দবন্ধ) রাজ্য গুলোর একটি হয়েও আজ বিহার বেশ পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে। এবং এটা যিনি ঘটিয়েছেন বিগত দশ বছরে, তিনি নিতীশ কুমার। যিনি আসলে বিহারের মাটি ও মানুষের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই উন্নয়নের পথে গিয়েছেন এবং তাই সেখানে বড় বাড়ি, বড় কারখানার আগে এসছে সুন্দর চওড়া রাস্তা আর স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়ন। বিহারে এই বছরের শেষে আসছে বিধানসভার ভোট এবং সেখানেও এক অভূতপূর্ব জোট তৈরি হয়েছে বা বলা যেতে পারে পুরনো জনতা দল জোড়া লেগেছে- শারদ যাদব ও নিতীশ কুমার এর জনতা দল(ইউনাইটেড), দেবগৌড়ার জনতা দল(সেকুলার), লালু প্রাসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, মুলায়াম সিং এর সমাজবাদী পার্টি একত্রিত হয়ে ভোটে নামার জন্য তৈরি হছে। তাই আগামী বিহার নির্বাচনে যখন মাটির কাছাকাছি(পুরনো স্থানীয় ভাষা, আচার ও লোকদের সাথে সম্পর্কযুক্ত) থাকা দলগুলি একত্রিত হয় তখন বিজেপি বা কংগ্রেস এর কিছু করার থাকবেনা বলেই মনে হয়।

ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আম আদমি দল এবং তার নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কথা না বললে অবশ্য মাটি-তন্ত্রের সার্বিক রূপ বুঝতে অসুবিধা হবে। আপ দলের প্রতীক হলো ঝাড়ু বা ঝাঁটা যা আসলে মাটি থেকে সমস্ত ময়লা সরানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। আপ ও চেয়েছে ভারতীয় রাজনীতির স্থবির দলব্যবস্থা ও রাজনৈতিক চিন্তার বন্ধ্যাত্ব থেকে দেশবাসীকে নতুন করে আন্দলিত করতে কিন্তু তারাও নিজেদের মধ্যে মাটি ও কাদা ছোঁড়াছুড়ি করছে(পড়ুন যোগেন্দ্র যাদব ও কেজরিওয়ালের মধ্যে মতান্তর) এবং পুরনো দলগুলির মতোই একটা স্বাভাবিক দল হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে যাদের প্রতিশ্রুতি ও প্রয়োগের মধ্যে ফারাক থেকে যাচ্ছে।

বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির আকাশ ও বাতাস সত্যি ‘ম’-এর প্রভাবে ম ম করছে- মোদী থেকে মমতা, মহেন্দ্র সিংহ টিকাওয়াত থেকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, মনমোহন থেকে মদন, মহাত্মা গান্ধী থেকে মদন মোহন মালিয়া, মন্দির-মসজিদ বিতর্ক থেকে ম্যাগি বিতর্ক- সবকিছু ভারতীয় মাটি থেকেই উঠে আসছে। গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে ভীষন ভাবেই ‘আমাদের মতন’- যেখানে নতুন ধারণা, নতুন ভাষা শৈলী, নতুন আচরণ শৈলী(মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণের সাথে মুখ্যমন্ত্রী বলতে পশ্চিমি ধারণার চিত্রর বিপরীত), নিত্যনতুন রাজনৈতিক জোট তৈরির কৌশল- ভারতীয় রাজনীতি-কে স্বকীয়তা দিয়েছে। এই স্বকীয়তা-কে অনেকেই গণতন্ত্রের পশ্চিমি ধারণার সাথে মেলাতে না পেরে গেল গেল রব তুলছেন। তাদের বোঝা উচিৎ আমাদের গণতন্ত্রের সার্বিক ব্যাকরণ আমাদের মতোই হবে- অস্থিরতা-কে বুঝতে হবে নমনীয়তা হিসাবে, চিৎকার-কে বুঝতে হবে উল্লাস হিসাবে, মতাদর্শহীনতা-কে বুঝতে হবে সৃষ্টির মুক্তির আবহাওয়া হিসাবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের এই নতুন ধরণের বোঝাগুলি-কে একত্রিত করে যে নামে সম্ভাষণ করতে পারি সেটা হল মাটি-তন্ত্র, যেখানে আমাদের নিজেদের মতো করে ছোটলোক-ভদ্রলোক সংস্কৃতির মিশ্রণে নতুন গণতন্ত্রের মডেল তৈরি হতে থাকবে আগামী দিনে।

সহকারি অধ্যাপক, রাস্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়