ছিটমহল হলো কাঁটাতারের এপারে মূল ভারতীয় ভূ-খন্ডের  ভিতর বাংলাদেশের গ্রাম। কাঁটাতারের ওপারে মূল বাংলাদেশ ভূখন্ডের  ভিতরে ভারতের গ্রাম।  স্থাবর সম্পত্তি, জমির একটা স্বত্ব থাকে। সেই স্বত্ব হলো তার হিসেব। তা থাকে জমির খতিয়ান অর্থাৎ পর্চা’য় । আমাদের যে গ্রাম-শহর, মফস্বলের সমস্ত জমিরই একটা হিসেব আছে, রাখা হয় জেলা কালেক্টরের কাছে। থানা লেভেলে ব্লক ল্যাণ্ড রিফর্মস অফিসে। ভারতের ভিতরে যে ৫১টি গ্রাম ( পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় ) বাংলাদেশের ছিটমহল, তার রেকর্ড, পর্চা খতিয়ান অর্থাৎ জমির স্বত্ব বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও পঞ্চগড় জেলা কালেক্টরেটে আছে। কারণ সেই গ্রামগুলির অধিকার বাংলাদেশের। আবার বাংলাদেশের ভিতরে ভারতের যে ১১১টি গ্রাম আছে, তার স্বত্ব আছে ভারত, পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলা কালেক্টরের হেফাজতে। এ এক অদ্ভুত ভূখন্ড, যে দেশ তার দেশ হওয়ার কথা, সে দেশ তার দেশ নয়।

ছিটমহলে প্রথম যাই বছর আড়াই আগে এক শীতের দিনে। সমস্তদিন ঘুরেছি সেই সব গ্রামে, যে গ্রামের  মানুষের  সেই  অর্থে  কোনো  দেশ নেই। কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার সীমান্তবর্তী সেই সব গ্রাম ভারতীয় ভূখন্ডের ভিতরে। কাঁটাতারের বেড়ার এপারে যে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, তার ভিতরে মিশে আছে টুকরো টুকরো বাংলাদেশ। যেন এক দেশের মানুষের ভিতর  মিশে থাকা অনুপ্রবেশকারী ভিনদেশি কেউ। আমি ছিটমহলের গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছি, জিজ্ঞেস করছি, ভারতে আছি তো? ভারতেই তো থাকব। কাঁটাতারের এপারে সবই ভারত।  আমাদের গাড়ি দিনহাটা থেকে যাত্রা করে শহর ছাড়িয়ে গঞ্জের ভিতরে প্রবেশ করে একটি বাজারে যেতেই সঙ্গী  বলল, এই আপনি বাংলাদেশে প্রবেশ করলেন।

গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েছি, বাংলাদেশ মানে, বর্ডার কই?

বর্ডার তো এখানে নয়, দূরে, দু’কিলোমিটার হবে।

কাঁটাতার?

আছে, ওই দুই কিলোমিটার পরে যেমন থাকে তেমনি।

সেই গ্রামের নাম বাতৃগাছি। স্বত্বে ভারতীয় ভূখন্ড নয়। বাংলাদেশের গ্রাম, কিন্তু তা ভারতের ভিতর রয়েছে। কাঁচা রাস্তা। রাস্তায় মাটি পড়ে না। খোয়া, পিচ পড়ে না। দুদিকে ধানকাটা মাঠ। অসংখ্য কাটা হাত জেগে আছে শুষ্ক ধরিত্রীতে। ধানের নাড়া। কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো। তারা ওই বাতৃগাছির মানুষ। তাই বাংলাদেশি নাগরিক, কিন্তু বাংলাদেশি পরিচয় পত্র নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই কাঁটাতারে দুই দেশের সীমান্ত নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায়। ছিটমহলের দেশ নেই বলা যাবে না। কিন্তু সেই দেশের সঙ্গে যোগ নেই। নিবার্সিত ভূখন্ড বলা যায়। তাদের দেশ পরিচয় বাংলাদেশ, কিন্তু আছে ভারতের ভিতরে। ভারতের ভিতরে ভিনদেশ বলে ভারতের নাগরিক তারা নয়। তাদের জেলা কোচবিহার নয়, কুড়িগ্রাম। থানা দিনহাটা নয়, ভুরুঙ্গামারি। অথবা ফুলবাড়ি। কুড়িগ্রাম, ভুরুঙ্গামারি, ফুলবাড়ি—সবই বাংলাদেশ। বাতৃগাছি গ্রামে সেই শীতের দিনে দেখলাম ডাঙা জমিতে তামাক হয়ে আছে। ঘন সবুজ পাতা তার। সুপুরি বনে ঘেরা গেরস্ত ঘর। একটি মসজিদ। সবই বাংলাদেশ। ভিনদেশ হওয়ার কারণে এখানে স্বাধীনতার পর কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া পড়েনি। এই গ্রামের কোনো পঞ্চায়েত নেই, ব্লক নেই, থানা নেই, মহকুমা নেই জেলা নেই, দেশ নেই এপারে। সবই আছে কাঁটাতারের ওপারে। এপারে কোনো স্ট্যাটাস নেই বলে, এখানে জল আসেনি পাইপ বাহিত হয়ে, আলো আসেনি। স্কুল নেই, হাসপাতাল-চিকিৎসা কেন্দ্র নেই। বাতৃগাছি ধরে হাঁটছি, আচমকা দেখলাম একটি  স্কুল বাড়ি। তার গায়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া পোস্টার স্বাক্ষরতার। বুঝলাম এই গ্রাম অন্য। আর এই গ্রাম ভারতে। গ্রামের নাম মদনাগুড়ি। মদনাগুড়িকে ঘিরে আছে আরো সব বাংলাদেশি ছিট। মদনাগুড়ির মানুষ ইন্ডিয়ান। কিন্তু খাস ইন্ডিয়ায় পা দিতে তাদের পার হতে হয় বাংলাদেশের ভূখন্ড। তারা বাংলাদেশের গ্রাম বাতৃগাছির মসজিদে যায় নমাজ আদায় দিতে। বাতৃগাছির মসজিদের ফজরের আজানে তাদের ঘুম ভাঙে। মদনাগুড়ির গায়ে বিস্তৃত সিঙ্গিমারি নদী। ওই নদী বাংলাদেশে ঢুকে ধরলা নাম নিয়েছে। ফুলবাড়ি ঘাট থেকে সেই ধরলা পার হয়েছি আমি গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের ভিতরে ভারত দেখতে গিয়েছিলাম। পরে সেই কথা হবে।

সেদিনই দুপুরে গিয়েছিলাম মশালডাঙা ছিটে। সে এক মস্ত গ্রাম। সার্ভে-সেটেলমেন্টে তার ১৯টি নকশা। মৌজা ম্যাপ। কাগজপত্র সব বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার কালেক্টরেটে। মশালডাঙায় পরেও আমি কয়েকবার গিয়েছি। অতি উর্বর মাটি এই গ্রামের। ফসলে ফসলে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকা সবর্ত্র। এই ছিটের মানুষ আজগার আলির বয়স ১০০-র উপরে। গ্রামের যুবক জয়নাল বলল, ১০৫। অনেকেই তা সমর্থন করল। আজগার আলিকে ঘিরে বসেছিলাম আমরা ক’জন। বৃদ্ধ বললেন, তিনি ইন্ডিয়ায় একবার ভোট দিতে চান। ইন্ডিয়া হোক মশালডাঙা তাই চান আজগার।

এই কথা কিন্তু ভারত বাংলাদেশ স্থল সীমা চুক্তির আড়াই বছর আগের। মশালডাঙা যেমন আজগার আলির গ্রাম, তেমনি আসমা নামের সেই বধূটির গ্রাম যাকে প্রসব বেদনার সময় গ্রামের মানুষ নিয়ে গিয়েছিল দিনহাটা হাসপাতালে। হাসপাতাল দেখতে চেয়েছিল ভারতীয় পরিচয় পত্র। না দেখাতে পারায় প্রত্যাখ্যান করেছিল। তখন দিনহাটার ও ছিটের মানুষ একত্রে দাবী করে পেশেন্ট প্রত্যাখ্যান করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের বিরোধী। রোগীর  নাগরিকতার পরিচয় জানার আগে তার চিকিৎসা জরুরি। এতে ছিটের কিছু মানুষ গ্রেপ্তারও হয়। শেষ অবধি সেই বধূকে হাসপাতাল নেয়। নিবির্ঘ্নে সে তার সন্তানের জন্ম দেয়। ছিটমহলের মানুষের জীবন এই রকম। ছিটমহল বিনিময় হোক, যে ভূখন্ড যে দেশের ভিতরে আছে সেই ভূখন্ড সেই দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাক, এই বিনিময় আন্দোলনের হোতা ছিলেন দিনহাটার ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টির বিধায়ক প্রয়াত দীপক সেনগুপ্ত। তাঁকে ভারত বাংলাদেশ, দুই দেশের ছিটমহলের বিপন্ন মানুষ আজীবন স্মরণ রাখবেন। ছিটমহলের এই যে অবস্থান, দেশের ভিতরে বিদেশ, এর পিছনে নানা কাহিনি আছে। সেই উৎসে যাওয়ার কথা ভাবি।

স্বাধীনতার পরে  সাবেক বাংলা প্রদেশ ( বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ ) সংলগ্ন করদ রাজ্য কোচবিহারের নৃপতি জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুর ভারত ইউনিয়নে তাঁর রাজ্য কোচবিহারকে ভূক্ত করেছিলেন। সাবেক কোচবিহার রাজ্যের অনেক অংশ ব্রিটিশ ভারতের ভিতরে ছিল।  কোচবিহারের রাজা ১৯৪৯-এ সম্মতি দিয়ে ভারত ভুক্ত হন।  ভূক্তির সঙ্গে সঙ্গে  কোচবিহার রাজ্যের সমস্ত মৌজা স্বাভাবিক ভাবেই ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিটিশ ভারতের কিছু মৌজা বহুদিন ছিল কোচবিহার রাজ্যের সীমার ভিতরে। ফলে কোচবিহার রাজ্যের যে যে মৌজা Radcliff  রোয়েদাদ বা বাউন্ডারি নির্ধারণে ওপারে, সাবেক পাকিস্তানে পড়ে যায়, এবং কোচবিহার রাজার অধীনস্ত হওয়ার কারণে ভারত রাষ্ট্রের অধীনস্ত বলে ঘোষিত হয়। একই ভাবে, ব্রিটিশ ভারতের যে যে গ্রাম বা কোচবিহার রাজ্যের সীমান্তের ওপারে জেলা রংপুরের জমিদার, তালুকদারের যে যে গ্রাম  কোচবিহার রাজ্যের ভিতরে ছিল, গোটা রংপুর জেলা পাকিস্তানে পড়ে যাওয়ায় তা পাকিস্তান হয়ে যায়। বাতৃগাছি বা মশালডাঙা কিংবা শিবপ্রসাদ মুস্তাফি ছিট (  রংপুরের জমিদার, তালুকদারদের সম্পত্তি) তাই ভারতের ভিতরে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ। ওপারে দশিয়ারছড়া, বালাপুকুরিয়া, কাজলডাঙা ইত্যাদি ( সাবেক কোচবিহার রাজার সম্পত্তি)  হয়ে যায় ভারত।  এই অবস্থান এমন হতো না যদি না কোচবিহার রাজা তাঁর সম্পত্তি নিয়ে ভারত রাষ্ট্রে যোগ দিতেন। কোচবিহার তো ছিল করদ রাজ্য, সরাসরি ব্রিটিশ ভারত নয়। Radcliff  রোয়েদাদ ব্রিটিশ ভারতে প্রযোজ্য ছিল। কোচবিহার রাজা ভারতের পক্ষে সম্মতি দিলেন ১৯৪৯ সালে, আর তাই তাঁর অধীনের সমস্ত সম্পত্তি, যার খাজনা তিনি পেতেন সব ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলো। যা তাঁর ছিল না, ছিল রংপুরের হয়ে ঢাকার নবাবের, নবাব পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় তা হয় পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশ। এপারের ৫১টি মৌজা তাই বাংলাদেশ, ওপারের ১১১টি তাই ভারত। যাঁরা বলছেন, ওদের তো দেশ ছিলই, তাহলে এই চুক্তি নিয়ে এত হৈচৈ কেন, তাঁদের বোঝা উচিত জমির জটিলতা। মশালডাঙা ( এপারে ) কিন্তু স্বত্বে, আইনে, রেকর্ডে বাংলাদেশ। আছে এপারে। মানে আমার দেশের ভিতরে এমনি ৫১টি ভিনদেশ।

এই বিচিত্র অবস্থানের পিছনে রয়েছে এক ইতিহাস। ষোড়শ শতাব্দীতে ফিরে যেতে হবে। ১৭২৭ সালে বাংলার নবাব মুরশিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পর মোগল সম্রাটের স্থানীয় শাসকের সঙ্গে কোচবিহার রাজার সম্পর্কের অবনতি হয়। তার ফলে বারবার কোচবিহার আক্রমণ করে মোগল সম্রাটের স্থানীয় শাসকরা। হটেও যায়। এদিকে কোচবিহার রাজ পরিবারেও রাজ্যের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কলহ জটিল হয়ে ওঠে। রাজ্যের আভ্যন্তরীন এই বিরোধের সুযোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী রঙ্গপুর-ঘোড়াঘাটের নায়েব ফৌজদার সৌলৎ জং ১৭৩৬ সালে কোচবিহার আক্রমণ করেন। এবং দখল করে নেন। এই যুদ্ধ হয়েছিল ঝাড় সিংহেশ্বরের প্রান্তরে।  যুদ্ধে রাজা উপেন্দ্রনারায়ণ পরাজিত হলেন। মোগল ফৌজদার উপেন্দ্রনারায়ণের এক জ্ঞাতি, দীননারায়ণকে কোচবিহারের সিংহাসনে বসিয়ে দেন। কিন্তু কোচবিহারের মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণ যোগাযোগ করেন ভূটানের রাজা দেবরাজের সঙ্গে। তাঁর সাহায্য নিয়ে মোগল ফৌজকে আক্রমণ করেন।  ১৭৩৭ সালে ধলুয়াবাড়িতে অনুষ্ঠিত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মোগল বাহিনী পরাজিত হলে মোগল ফৌজদার কাশেম আলি খাঁ ও দীননারায়ণ পার্শ্ববর্তী রংপুরে পালিয়ে যান। কিন্তু মোগল ফৌজ প্রাথমিক ভাবে যে সব মৌজা অধিকার করেছিল, রংপুরের সীমান্তবর্তী সেই সব মৌজায় মোগল সৈন্যরা বাস করতে থাকে এবং তারা মোগল শাসনের প্রতি আনুগত্য রেখে দেয়। কর দেয় মোগল সম্রাটকে। রংপুরের চাকলাদার, তালুকদার, জমিদাররা খাজনা নিতেন মোগলের হয়ে। বাংলার নবাবের হয়ে। এইসব ভূ-খন্ডের অধিবাসীদের আনুগত্য সেই ভাবেই হয়ে যায় বাংলার নবাবের প্রতি। স্থানীয় ভাবে নবাবের প্রতিনিধি  কাকিনা, কারষিহাট ও ফতেপুর চাকলা অঞ্চলের চৌধুরীদের প্রতি।  এই সব ভূ-খন্ড আয়তনেও কিছু কম ছিল না। অতি বৃহৎ হওয়ার কারণে এই চাকলাগুলির জমিদারদের প্রতিপত্তি ছিল খুব। আর স্বাভাবিক ভাবেই এইসব ভূ-খন্ড হয়ে পড়ে রংপুর প্রশাসনের অধীন। কোচবিহার রাজ্যের সীমানার ভিতরের মৌজাগুলিকে বলা হত মোগলান।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হয়ে ভারত যখন মোগল ভারত থেকে ব্রিটিশ ভারত হয়ে গেল, তখন কোচবিহার রাজ্যের সীমানার ভিতরে থাকা মোগলান মৌজাগুলির অধিকার স্বাভাবিক ভাবে ব্রিটিশের হয়ে যায়। এই সমস্যা ব্রিটিশরা সেভাবে সমাধান করেনি, প্রয়োজনও ছিল না। তারা কোচবিহার রাজ্যের ভিতর থেকে আলাদা করে কিছু রাজস্ব পেত, সুতরাং তা ছাড়বে কেন? আর মোগলানগুলির বাসিন্দারাও কোনো অসুবিধে ভোগ করেনি সেইভাবে। কোচবিহারের রাজা একে কোনো সমস্যা বলেও মনে করেননি। ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাবেন কেন? এক ইতিহাস বলে এই হলো ছিটমহল জন্মের উৎস। কিন্তু তাহলে রংপুরের চাকলা, তালুক, জমিদারির ভিতরে কোচবিহার রাজার অধীনস্ত মৌজা থাকে কী করে ? আর তার সংখ্যা অনেক বেশি, আয়তনও অনেক বেশি। এপারে ছিল ৫৩ মৌজা, ওপারে ১১১। এপারের থেকে ওপারের আয়তন মোটামুটি দশ হাজার একর বেশি। তাহলে মোগলের চেয়ে কোচবিহারের জোর কি ছিল বেশি? জট পাকিয়ে যায় সবটা। এই নিয়ে আর এক কথা শোনা যায়। তা শোনাতে  একটি বাস্তবতার কথা বলি, যে বাস্তবতাকে দেখা যায় ছিটমহলে গেলে।

বাংলাদেশি ছিট মশালডাঙা একটি মৌজা, যার সেটেলমেন্ট নকশার সংখ্যা ১৯। মধ্য, উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম। এখন মধ্য মশালডাঙার ভিতরে আড়াই একর(  সাড়ে সাত বিঘে )-এর মতো একটি ভূখন্ড আছে, যা ইন্ডিয়া, ভারতের ছিট বাংলাদেশের ভিতরে। বাংলাদেশী ছিটে ঘেরা একটি ভারতীয় ছিট মদনাগুড়ি দেখেছি। বালাপাড়া খাগড়াবাড়ির ভিতরে একটি বাংলাদেশি ছিট উপেনচৌকি ভজনী রয়েছে, তার ভিতরে একটি ভারতীয় ছিট ১ একরের মতো ভূখন্ড  দহলা খাগড়াবাড়ি। দেশের ভিতরে বিদেশ,  তার ভিতরে দেশ। দেখেই ধরা যায় রংপুর এবং কোচবিহারের অধিপতি যেমন ইচ্ছে ভাগ বাটোয়ারা করেছিলেন। কোনো যুক্তিই এখানে টেকে না। ছিটমহলগুলির অবস্থানের চেহারা ছিন্নভিন্নর মতো।  বাংলাদেশ এবং ভারতের গ্রামগুলি গায়ে গায়ে লেগে আছে। একে অপরের ভিতর ঢুকে আছে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। radcliff  রোয়েদাদ এই ঘটনা ঘটায়নি। সেই বাউন্ডারি কমিশন তো মানচিত্রের উপর লাইন টেনে দেশটাকে পুবে ও পশ্চিমে তিন ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল। তাতে আমার বাড়ি এধারে, রান্নাঘর ওপারে পড়ে গিয়েছিল কোথাও কোথাও, কিন্তু এক দেশের ভিতরে আর এক দেশ ঢুকে বসেনি। এই অবস্থা কী করে হলো?

কেউ কেউ বলেন, বাজি রেখে পাশা খেলা হত রাজায় নবাবে, তাতে রাজার মৌজা রংপুরের তালুকে  গেছে, রংপুরের মৌজা এসেছে রাজার কাছে। এই কারণেই  মৌজাগুলির এমন এলোমেলো অবস্থা। মহাভারতের পাশা খেলা বুঝি। তারপর ১৯৪৯-এ কোচবিহার ভারতে ভুক্ত হলে, কোচবিহার রাজার সমস্ত ভূসম্পত্তি ভারতে এলে, ওপারে রংপুরের ভিতর পড়ে থাকা রাজার গ্রামগুলি আইনত ভারত হলো। আর তেমনি এপারে রংপুরের ভূমধ্যাকারীর সম্পত্তি পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশ হলো।   এই কাহিনির সত্যতা কিন্তু অনুভব করা যায় ছিটমহলে গেলে। যেখানে সেখানে বাংলাদেশ বা ভারত দেখে যেন তাই-ই  মনে হয়। মনে হয় দুই দেশের সরকারই যেন বসেছিল মহাভারতের পাশা খেলায়।  পাশার দান দিয়েছিল। বাজি ধরেছিল ভূমি নিয়ে। এক একটা মৌজা এদিক থেকে ওদিকে চলে গিয়েছিল। আর সেই রাজায় রাজায় কপট যুদ্ধের ফল ছিটমহলের জন্ম। আর তার বাসিন্দাদের এত বছর ধরে দেশহীন হয়ে থাকা। উন্নয়ন, নাগরিকতা, চিকিৎসার সুযোগ, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এই সমস্ত ১৬২ গ্রামের( দুই দেশ মিলে) মানুষ। কোনোরকম আইনের সাহায্য থেকে বঞ্চিত।  মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। একটি উদাহরণ দিই। ভারতের ভিতর বাংলাদেশি ছিট শিবপ্রসাদ মুস্তাফিতে  একটি মেয়ে ধর্ষিতা ও খুন হয়। সেই মেয়ে এই দেশেরই। কিন্তু সেই ঘটনার তদন্তে এই দেশের পুলিশের যাওয়ার অধিকার ছিল না। লাশ পড়ে ছিল কয়েকদিন। অতঃপর ভারত বাংলাদেশের যৌথ আলোচনা শেষে অনুমতি নিয়ে এদেশি পুলিশ ওই ছিটে প্রবেশ করে  লাশ উদ্ধার করে। একই ঘটনা ওপারে বাংলাদেশের ভিতরে ভারতীয় ছিটগ্রাম ১৬ নং বাঁশকাটায় ঘটেছিল। ছিটমহলের ভিতর যদি কোনো অন্যায় হয়, তার প্রতিকার হবে না। কোথায় অভিযোগ করবে মশালডাঙার মানুষ? তাদের থানা যে ভুরুঙ্গামারি। তাদের জেলা যে কুড়িগ্রাম, বাংলাদেশ। এমনি অবস্থা ওই দেশের ভিতরে ১১১ ভারতীয় মৌজারও।  ভারতের ভিতরে এই কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি জেলার ৫৩ মৌজার দুটি, কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমা সংলগ্ন অঙ্গারপোতা ও দহগ্রাম ছিল বাংলাদেশের ছিট। ভারতীয় সীমান্ত কুচলিবাড়ির গায়ে দেড় কিলোমিটারের ভিতর। সেই দুটি গ্রামকে একটি করিডোরের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশের পাটগ্রাম থানার পানিগ্রাম মৌজার সঙ্গে।  করিডোর করতে  ১৭৮ মিটার দীর্ঘ ও ৮৫ মিটার প্রস্থ জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে ভারতীয় প্রশাসনকে। সেই জমি বাংলাদেশকে ৯৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে হয়েছে। আমি গত বছরের ১৬-ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের ভিতরে ভারতীয় ছিট  দশিয়ারছড়ায় উপস্থিত হয়েছিলাম। এই ছিট গ্রামটি বাংলাদেশের ফুলবাড়ি থানার ভিতরে হলেও, আইনত তা কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার অন্তর্ভুক্ত। দিনহাটা কাঁটাতারের ওপারে। এখানকার দশ হাজারের উপর বাসিন্দারা কেউ দিনহাটা, কোচবিহার, ভারত দেখেননি।

ছিটমহল বিনিময় চুক্তি শেখ মুজিবর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর ভিতরে ১৯৭৪-এ সম্পাদন করা হয়েছিল। তারপর ৪১ বছর গেছে, চুক্তি রূপায়ন করা হয়নি। ছিটমহলগুলি দেশের ভিতরে বিদেশ হয়ে পড়ে ছিল। আর ছিটের বাসিন্দারাও অলীক নাগরিকত্ব মুছে দিয়ে প্রকৃত নাগরিকত্ব পাননি। দুই দেশের এতগুলি গ্রাম ছিল রাষ্ট্রহীন হয়ে। তারা এতদিনে রাষ্ট্র পেতে যাচ্ছে। রাষ্ট্র পাওয়া মানে ছিটের কন্যা জিন্নতকে কেউ নিরন্তর ভয় দেখাতে পারবে না, তুলে নিয়ে যাবে বলে। সে যদি অপহৃত হয়, সেই অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার জায়গা ছিল না। ছিটমহলের এই দেশহীনতা, প্রশাসনহীনতা সেখান থেকে কত যুবতীকে অদৃশ্য করে দিয়েছে তার হিসেব নেই। প্রশাসনহীনতা করেছিল স্মাগলিঙের স্বর্গ রাজ্য।

সায়মা বিবির সন্তানকে পোলিও খাওয়াতে যেতে হয়  মূল ভারতে পোলিও ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে তার ঠিকানা হয় মূল ভারত। তার ফলে স্বামীর নাম বদলে যায়। ছিটের শিশু তো দেশের নাগরিক নয় কোনো দেশে। তাই তার বাবার নাম বদলে ভারতের কারোর নাম করা হয়। এই নাম বদল কি এমনি হয়? টাকা তো দিতে হয় ফেক-হাজব্যান্ডকে, ফেক-ফাদারকে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে হলে ভারতের ঠিকানাওয়ালা বাবার নাম চাই। সেই পিতা আসল পিতা নয়। ভাবুন। সেই মধ্য ডিসেম্বরে আমি বাংলাদেশের তিন জেলা, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় এবং নীল ফামারীর ছিটে ঘুরেছিলাম। মানুষের ছিল একটিই জিজ্ঞাসা, কবে  তারা অপরিচয়ের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবে। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার সীমান্তের এপার ওপারে এই সমস্ত ছিটগ্রামগুলি। এই সব গ্রাম কোনো দেশের মানচিত্রেই ছিল না। অসম্পূর্ণ মানচিত্র এখন নতুন করে আঁকা হবে। আর তাই মানুষের মুখও নতুন করে আঁকা হবে। ছিটমহলের মানুষ এতদিনে প্রকৃত দেশ পেল। স্বাধীনতাও পেল। আর নিজ বাসভূমে অনুপ্রবেশকারী বলে ফাটকে ঢোকাবে না রক্ষীবাহিনী। ছিট থেকে বের হলেই তো ছিল ভিনদেশ। ভিনদেশ এখন স্বদেশ হলো। প্রয়োজন রাস্তাঘাট, আলো, জলের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজন পরিচয়পত্র দেওয়া। আর সাবধানে জমির স্বত্ব বিনিময় হওয়া প্রয়োজন। এই কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। জমির স্বত্বের উপরই তো মালিকানা। না হলে ছিটের বাসিন্দা নয় এমন জমি হাঙর জমি দখল করে নিজের নাম পত্তন করতে চেষ্টা করবে। বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। আমরা যারা বলছি, ছিট বিনিময় অনর্থক, আমরা জানিই না রাষ্ট্রহীন হয়ে থাকা কত ভয়ের। কত দুর্দশার। এপারের ৫১ ভারতে স্বাগত। ওপার থেকে যদি মানুষ আসেন এপারে সেই ভারতের নাগরিকতা বজায় রাখতে, তাঁদের সম্মানজনক পুনবার্সন দিতে হবে। এখন কাজটা অনেক।

লেখক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক।